ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিদার হাসান

অসীমে প্রাণমন লয়ে...

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩ জুলাই ২০১৭

অসীমে প্রাণমন লয়ে...

ড. করুণাময় গোস্বামীর চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। বরং তাঁর কীর্তির উজ্জ্বলতায় আরও বেশী স্মরণযোগ্য হয়ে ওঠার নামান্তার। মাত্র ৭৫ বছরের যাপিত জীবন তাঁর। শারীরিকভাবে সুস্থ এবং কর্মঠই ছিলেন। সঙ্গীত নিয়ে ভেবেছেন নিরন্তর। লিখেছেনও বিস্তর। নজরুল-রবীন্দ্রনাথই তাঁর ভাবনা কেন্দ্রে সর্বদা স্থান পেয়েছে। শিক্ষকতা ছিল তাঁর পেশা; কিন্তু নেশা ছিল সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা। বিস্তর পঠন-পাঠন ছিল, অন্তত সঙ্গীত আরাধ্য বিষয় বলেই! গত ১২ মে একটি হোটেলে এক কৃতী শিল্পীর সংর্বধনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন এবং তাঁর এ বিষয়ে লব্ধজ্ঞান প্রসঙ্গান্তরে খানিক নিবেদনও করেছিলেন। সেই তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা ও কথা। তাঁর একটি সাক্ষাতকার নেয়ার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল বলে বেশকিছু প্রশ্ন তাঁকে দিয়েও ছিলাম ভাবার জন্য। বলেছেন কিছুদিন পর আমায় ফোন করবেন অবসরে, তারপর দেবেন প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু দুর্ভাগ্য সে সুযোগ আর হলো না। তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে। জীবন এবং মৃত্যু কতটা কাছাকাছি, কতটা সহাবস্থান ভাবতে গেলে বিস্ময় লাগে! পরিচয়ের পর থেকে দেখেছি (ঘরে-বাইরে) সমাজ-সংস্কৃতি নিয়েই তাঁর ছিল ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা। সুগভীর চিন্তা-ভাবনার নির্যাসও মেলে তাঁর লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধে। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর অধ্যয়ন বলেই ভাষাজ্ঞান ছিল প্রখর কিংবা এর প্রতি দখল সৃষ্টি হয়েছে নিবিড় আগ্রহেই। তিনি আগাগোড়া একজন শুদ্ধ-পরিশীলিত মানুষ। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও ঠিক তাই। আবদুল্লা আবু সাঈদ, ড. হায়াৎ মামুদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, শামসুজ্জামান খান প্রমুখের ভাবনা-চিন্তা থেকেও আঁচ করা যায় কেমন মানুষ ছিলেন তিনি। গত মে মাসের গোড়াতে তাঁর সর্বশেষ উপন্যাসগ্রন্থ- ‘লাহোরের রহিম খের’-এর মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভার আয়োজন ছিল বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে। উপস্থিত থাকার জন্য বলেছিলেন; কিন্তু যেতে পারিনি বলে খেদ রয়ে গেছে মনে। এর আগে ২০১৫ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাসগ্রন্থ- ‘ভারত ভাগের অশ্রুকণা’ প্রকাশ পায়। তাঁর এই উপন্যাস দু’টিই ভারত ভাগের পটভূমি নিয়ে রচিত। ইতিহাসের বেদনাঘন অধ্যায় নিপুণভাবে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। অনেকে এ উপন্যাসকে কালজয়ী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আরও উপন্যাস লেখা শুরু করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। যদিও তার পটভূমি জানা হয়নি। তবে ক্যামব্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার ও কালচারাল একাডেমির অফিস রুমে বসে তাঁর সঙ্গে একান্তে আলাপকালে দেখেছি তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে লিখছেনÑ কী লিখছেন স্যার? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছেনÑ উপন্যাস। ইতিপূর্বে তাঁর পরিচয় আমার কাছে অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর তাঁকে আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। তিনি একজন শক্তিমান ঔপন্যাসিকও। আসলে করুণাময় গোস্বামী ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত একজন পরিপূর্ণ মানুষ। সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তাঁর পরিচয় সর্বজন সুবিদিত; কিন্তু এর বাইরে, একজন গবেষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক, সঙ্কলক ও কলাম লেখক হিসেবেও তিনি যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। তাঁর অনুবাদকর্মের অনন্য স্বাক্ষর ‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব’। তাছাড়াও আফ্রিকার বহু জনপ্রিয় ও আলোচিত গল্প-কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সম্পর্কে ঈর্ষণীয় গবেষণামূলক কাজ করেছেন এবং এর স্বীকৃতিস্বরূপ সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত। নজরুলের পূর্ণাঙ্গ জীবনী ইংরেজীতে রচনার প্রথম কৃতিত্বের অধিকারী ব্যক্তিটির নাম করুণাময় গোস্বামী। বাংলাদেশে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক গবেষণা-প্রবন্ধে তিনি একজন অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। মাত্র ৭৫ বছরে এই কীর্তিমান পুরুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়াতে দেশের যে ক্ষতি হলো তা বর্ণনাতীত। আসলে কীর্তিমানদের সৃষ্টিশীল, কর্মক্ষম জীবন যত দীর্ঘ হয় দেশ তত উপকৃত ও সমৃদ্ধ হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য অনেক কীর্তিমানের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে না। ড. করুণাময় গোস্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে, তিনি রবীন্দ্র বিষয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক গ্রন্থের প্রণেতা। দুই বাংলায় তিনি এ বিষয়ে সমীহ জাগানিয়া নাম। মানুষ হিসেবেও ছিলেন চমৎকার। সদালাপী। স্পষ্টভাষী। প্রাণবন্ত। বিষয়-ভাবনায় সতর্ক এবং সিরিয়াস। বারিধারা ডিওএইচএসের বাসায় তিনি স্ত্রীসহ বাস করতেন। তাদের দু’সন্তান (এক ছেলে এক মেয়ে) আমেরিকা ও কানাডা প্রবাসী। দু’জনে প্রায়শই সেখানে যেতেন প্রিয় সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে। স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাবেননি। শিকড়-ভালবাসার টানে চলে আসতেন প্রিয় স্বদেশে। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার পর কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মাস আমেরিকা-কানাডায় প্রবাস জীবন কাটিয়ে শেষে ফিরে এসেছিলেন ঢাকায়, নিজ বাসভূমে। একজন অসাম্প্রদায়িক মুক্ত চিন্তাচর্চার মানুষ হিসেবে তিনি উগ্র-ধর্মান্ধদের বর্বরতায় ক্ষুব্ধ, ব্যথিত হয়েছিলেন। জীবন, দেশ, মাটি, মানুষ যাদের প্রিয় নয়, তাদের প্রতি কি কারও করুণা জন্মে! ড. করুণাময় গোস্বামী যেহেতু মানবতাবোধে উজ্জীবিত একজন সৃজনশীল মানুষ, তাই তাঁর জীবনবোধ ছিল শান্ত, শুভ ও কল্যাণের। তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন সরকারী কলেজেÑ নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ, মহিলা কলেজ, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ, করটিয়া সা’দাত কলেজ ইত্যাদি। ২০০১ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়ে পরবর্তীতে বেসরকারী ক্যামব্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার ও কালচারাল একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। আমৃত্যু সে পদেই ছিলেন। মননশীল সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর স্ত্রী শিপ্রা রানী দেবীও অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনিও অবসর জীবনযাপন করছেন। জটিল কোন রোগে আক্রান্ত বলে শুনিনি। দু’জন মোটামুটি সুস্থই ছিলেন। হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং বাথরুমে পড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে কাছে ডেকে নেন। রবিবার তাঁর ছেলে সায়ন্তন গোস্বামী ও মেয়ে তিথি গোস্বামী প্রবাস থেকে ফিরেছেন প্রিয় পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ও শেষকৃত্যে অংশ নিতে। নারায়ণগঞ্জে তিনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, সরকারী তোলারাম কলেজ ও সরকারী মহিলা কলেজে শিক্ষকতার সুবাদে। তাই পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে প্রিয় স্থান নারায়ণগঞ্জেই। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬৮। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, গুণ-মানের বিচারেও তাঁর গ্রন্থাবলী বিশেষ গুরুত্ববহ। তাঁর ‘সঙ্গীত কোষ’ গ্রন্থটি সঙ্গীত অভিধান হিসেবে বহুল আলোচিত। এছাড়া বাংলা গানের বিবর্তন, নজরুলগীতি প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রসঙ্গীতকলা, রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিক্রমা, অতুল প্রসাদের গান সঙ্গীতের আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। রাসবিহারী গোস্বামী ও জ্যোৎস্না রানী দেবীর সাত সন্তানের মধ্যে করুণাময় গোস্বামী দ্বিতীয়। জন্ম ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার গোঁসাই চান্দুরা গ্রামে ১৯৪৩ সালের ১১ মার্চ। আর চিরপ্রস্থান ৩০ জুলাই ২০১৭। পিছনে রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি। করুণাময় গোস্বামী বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবেন তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টির জন্য, কীর্তির জন্য। তাঁর প্রিয় একটি গান দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতুদূরে আমি ধাই/কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নাই... লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×