ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন দাঁড়াল বাজেট ২০১৭-১৮

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩ জুলাই ২০১৭

কেমন দাঁড়াল বাজেট ২০১৭-১৮

২০১৭-১৮ অর্থবছর বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যময়। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেগবান করতে জাতীয় বাজেটের ভূমিকা অনেকখানি। গত ২৮ জুন সরকার প্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার পর জাতীয় বাজেটে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন অর্থমন্ত্রী। লক্ষণীয় যে, সরকার প্রধান একটি যৌক্তিক বক্তব্য রেখেছেন কেউ কর ফাঁকি দিলে নিজে ঠকবেন। আসলে কর ফাঁকি দিয়ে বিত্তশালীরা অনেকক্ষেত্রেই পার পেয়ে যান। এর ফলে তারা সত্যিকার উন্নয়ন চান কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায়, গ্রিক জাতির সঙ্গে একটি জায়গায় আমাদের মিল আছেÑ তারাও কর দিতে চায় না আমরাও কর না দেয়ার ফন্দি করে থাকি। অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কর ফাঁকির রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু বিখ্যাত ব্যক্তিই বলুন, আর ক্ষমতাসীনই বলুন কেউ কিন্তু কর ফাঁকি দিয়ে রেহাই পায় না। বিওনবর্গ থেকে আরম্ভ করে স্টেফিগ্রাফের পিতাকেও কিন্তু কর ফাঁকির জন্য শাস্তির আওতায় আসতে হয়েছে। লক্ষণীয় যে, এবারের বাজেট যখন সংসদে পেশ করা হয় তখন রমজান মাস চলছিল। তারপরও নয়টি প্রধান খাদ্যদ্রব্যের বাজার যাচাই করে দেখেছি যে, একমাত্র চালের মূল্য ছাড়া অন্য কোন দ্রব্যের দাম পূরবর্তী বছরের তুলনায় বাড়েনি। এটি একটি ইতিবাচক দিক। একদিকে হাওড়ে ধানের উৎপাদনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ধসকে কেন্দ্র করে যে ধরনের খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টির সুযোগ নিতে চেয়েছিল সুযোগ সন্ধানীরাÑতারা তেমন সফল না হলেও দেশে পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও মিল মালিক আর পাইকাররা একে অপরকে দোষারোপ করতে করতে চালের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটি আসলে এক ধরনের ওলিগপ্লিস্টিক নেচারের কার্টেল সিস্টেম। সরকার ব্যবস্থা নিয়েছেন। ট্যারিফ হ্রাস করে ১০% করেছেন। আমদানিকৃত পণ্য হিসেবে চাল অবশ্যই আমদানি হবে। কিন্তু দেশে পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও যারা দ্রব্যের দাম বাড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এমনকি আমদানিকৃত চাল যেন ক্রেতা সাধারণের নাগালেও সহনীয় পর্যায়ে বিক্রি করা যায় সেজন্য বেসরকারী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি টিসিবি এবং বিএডিসিকে চাল আমদানি ও বাজার পর্যবেক্ষণ ও তদারকির ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টি কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। টিভিতে সংবাদ হিসেবে দেখাল যে, সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও হাওড় অঞ্চলে কোন কোন এনজিও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঋণ আদায়ে সচেষ্ট রয়েছে। যেসব এনজিও মহাজনী কায়দায় ব্যবসা করে থাকে তাদের ব্যবসা করা থেকে বিরত রাখার জন্যে প্রয়োজনে নিবন্ধন বাতিল করা দরকার। শেষ পর্যন্ত মানুষের সবচেয়ে বেশি চিন্তার খোরাক আবগারী শুল্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এক লাখ টাকা পর্যন্ত কোন ধরনের আবগারী শুল্ক থাকবে না। এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা আবগারী শুল্ক হবে। পাঁচ লাখ টাকা থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত হবে পাঁচ শ’ টাকা। আর দশ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারী শুল্ক হবে ২৫০০ টাকা। আর এক কোটি টাকার উর্ধে এবং পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারী শুল্ক হবে ১২,০০০ টাকা। পাঁচ কোটি টাকার উর্ধে হলে আবগারী শুল্ক হবে ২৫,০০০ টাকা। ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারী শুল্কের এ পরিবর্তনটি সাধারণ জনমানুষের মধ্যে স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথম দুটো প্ল্যানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আবগারী শুল্কের চেয়ে কম রাখা হয়েছে যেহেতু অর্থনীতি বড় হচ্ছে, মানুষের আয় প্রবাহ বাড়ছে। ভ্যাট আইনটি আগামী দু’বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়া হলো। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন করতে গেলে কয়েকটি বিষয় সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে সততা। একই দ্রব্যের ট্যাক পরিবর্তন করে উচ্চ মূল্য রাখার প্রবণতা বাজারে দেখা যাচ্ছে। একটি বাস্তব উদাহরণ দেই। চেইন স্টোরে ম্যাগী পেস্তার দাম রাখা হচ্ছে ৮৫ টাকা অথচ ধানম-ির অভিজাত বিপণিতে ওই একই পেস্তার ট্যাকে দাম লেখা আছে ৬০ টাকা। এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ অবশ্যই দরকার। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় করতে হলে যে ধরনের যন্ত্রপাতি লাগে কি দামে ক্রয় করা হচ্ছে তা বোঝার ব্যবস্থা দরকার সেটি পর্যাপ্তভাবে দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। আবার ভ্যাট আইনে দ্রব্যের গুণগতমান অনুসারে অপ্রত্যক্ষ কর বসানো উচিত। অর্থাৎ বিলাসী দ্রব্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্য, বেঁচে থাকার অবলম্বন, সাধারণ দ্রব্যÑএ চারটি ভাগে ভাগ করে ভ্যাট বসানো দরকার। জননেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কথা চিন্তা করে ভ্যাট আইন দু বছরের জন্য স্থগিত করে একটি ইতিবাচক কাজ করেছেন। এটি নিয়ে সাধারণ মানুষ বেশ দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল যদিও ব্যবসায়ীরা মায়া কান্না করলেও শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই কিন্তু মূল্য চুকাতে হতো। শেক্সপিয়ারের সে অমর বাক্য উচ্চারণ করছি ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার।’ আগামী দু’বছরে এনবিআর ভ্যাট আইনকে আরও বাস্তবসম্মত এবং অধিক সংখ্যক দ্রব্যের উপযোগী করে তৈরি করবেন এ প্রত্যাশা রইল। রাজস্ব আদায়ে যে ঘাটতি আছে তা সত্যিকার অর্থে বিত্তশালী ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় এর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর ও কর্পোরেট ট্যাক্সের মাধ্যমে এনবিআরকে সক্ষমতা ও উদ্ভাবনী কলা কৌশলের অধিকারী হতে হবে। প্রত্যক্ষ কর যত বেশি বৃদ্ধি পাবে ততই এনবিআর নিজেদের কাজে যেমন কৃতকার্য হবে তেমনি দেশের অগ্রযাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে। সমস্যা হলো যারা উচ্চবিত্তের অধিকারী তারা কিন্তু ঠিকমতো প্রত্যক্ষ কর দেন নাÑএটি যেমন ব্যক্তি পর্যায়ে তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও সত্য। অনেক সময়ে এনবিআরের সৎ কর্মকর্তারাও কর আদায়ে মনোবল হারিয়ে ফেলেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের প্রটেকশান দেয়ার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের। ট্যারিক কমিশনকে অবশ্যই এনবিআর এর নিয়ন্ত্রাধীন থেকে বের করে এনে সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আনা উচিত। ভ্যাট আইনকে দু’বছরের জন্যে স্থগিত করে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে সরকার, এখানেই গণতন্ত্রের জয়। বর্তমান বাজেটে সেফটি নেট বাড়ানো হয়েছে এটি একটি ইতিবাচক দিক। দলিত সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গ আর প্রতিবন্ধীসহ বয়স্কদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। তবে প্রতিবন্ধীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে সে জন্যে অবশ্যই স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাজেটে জনবান্ধব যে সমস্ত কার্যক্রম ছিল তা নিয়ে কিন্তু তেমন আলোচনা হয়নি। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংস্কার যত বেগবান হবে তত দেশের জন্যে মঙ্গল হবে। সরকার শিক্ষানীতি ২০১০ ঘোষণা করেছেন যা একটি আদর্শ শিক্ষানীতি অথচ এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে শিক্ষা আইন প্রয়োজন যেটি গত দু’বছর ধরে পাস হচ্ছে না। তেমনি এনভায়রনমেন্ট আইনটি সময়ের বিবর্তনে সংস্কার সাধন করা বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে। ধ্যান বা যোগের ওপর ভ্যাট রহিত করা একটি ইতিবাচক দিক। কেননা স্বাস্থ্য ভাল থাকলে মানুষ কর্মক্ষম থাকবে। কম্পিউটার, মুঠোফোন এবং এর যন্ত্রাংশ দেশে তৈরি হলে ভ্যাটমুক্ত থাকবে বলে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেন। অবশ্য আগামী ১ জুলাই থেকে দেশী-বিদেশী সকল ধরনের মোবাইল ফোন সেটের আমদানি ও সরবরাহের ওপর ১ শতাংশ হারে সার চার্জ জারি করেছে এনবিআর। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ লিমিটেড যেসব পণ্য বিনা শুল্কে আমদানি করে সেগুলোর ওপর ভ্যাট থাকবে না। বরং দেশীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে সাবসিডি দেয়া যেত। প্লাস্টিক ও গ্লাসফাইবারে তৈরি কনটেইনার আমদানিতে কোন ভ্যাট রাখেননি, সোলার প্যানেলের ওপর ১০% আমদানি শুল্ক শেষ পর্যন্ত তুলে নেয়া হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। অর্থমন্ত্রী যাতে দেশে মোটর সাইকেল ও গাড়ি উৎপাদিত হয় সে জন্য জাপানি দূতাবাসও নিটল নিলয়ের সঙ্গে তার ফলপ্রসূ বক্তব্যের আলোকে কথা বলেছেন। তবে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ থাকলে ভাল হতো। তৈরি পোশাক খাতে উৎস কর ১% বহাল রাখা হয়েছে। সবুজ কারখানার ক্ষেত্রে ১০% কর্পোরেট কর এবং ১২% অন্যদের ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে যেসব পোশাক মালিক দেশের বাইরে পোশাক কারখানা স্থাপন করছেন তাদের ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা কম দেয়াই বাঞ্ছনীয়। দেশীয় শিল্পের সংরক্ষণ ও বিকাশে আরও তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুঁজি বাজার সম্পর্কে অন্তত শেষ দিনেও কিছু দিক নির্দেশনা অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করা গিয়েছিল। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়নের জন্য অবশ্যই উদ্যোক্তা তৈরির জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। এ জন্য স্নাতক পার্যায়ে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিক্সের মাধ্যমে দেয়া যেতে পারে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬টি কোর্স রয়েছে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য। আসলে বর্তমান যুগে উদ্যোক্তা তৈরি করতে হলে প্রয়োজনীয় অর্থ-শিক্ষা ও বরাদ্দ প্রয়োজন। সম্প্রতি দেশে যে হারে পাস করে শিক্ষার্থী বেরুচ্ছে সে তুলনায় চাকরির সুযোগ কম। বিবিএসের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায় ৮৭% কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয়। এদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ধীরে ধীরে আনতে হবে। এজন্যে একটি সুস্পষ্ট কর্ম পরিকল্পনা দরকার। অবশ্য এ বিষয়ে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন কাজ করে চলেছে। তবে এটিকে আরও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও হাওড় অঞ্চলে পিকেএসএফএর পার্টনার অর্গানাইজেশন বাড়াতে হবে। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের খোলনলচে পরিবর্তন করে ভিশন, মিশন ঠিক করা উচিত। এসডিজি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবার একযোগে কাজ করতে হবে। ব্যাংকিংসহ আর্থিক খাত দুর্নীতিমুক্ত করা এবং কর্মকর্তা কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে দিক নির্দেশনা কাম্য ছিল। ২০১৭-১৮-এর বাজেট মোটা দাগে বলাচলে জনকল্যাণমূলক। যে সব ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল তা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দূর হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ে বিশদ আলোচনা ও দিকনির্দেশনা দেয়া উচিত ছিল। রাজস্ব নীতির সঙ্গে মুদ্রা নীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা নীতির সুস্পষ্ট সমন্বয় দরকার। সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এটি উদ্বেগজনক। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকনোমিস্ট [email protected]
×