ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ চরমপত্রের মুকুল

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ চরমপত্রের মুকুল

২০১৭ সালের ২৯ জুনের দৈনিক জনকণ্ঠের চার নম্বর পাতা খুলতেই চোখে পড়ল এক অকুতোভয় শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা চরমপত্রের মুকুলের দীপ্ত চেহারা। চমকে উঠল চোখ-মন ও মনন। পত্রিকাটির অর্ধেক পাতাজুড়ে যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই সময়ের রেডিও, বিজয়ের পতাকা এবং মুকুলের নিজ হাতে লেখা চরমপত্রের খসড়া। যেন মুূহূর্তে ভেসে এলো ইথারে সেই গেরিলার গভীর গর্জন ‘আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শেষ। আইন ১৬ ডিসেম্বর চরমপত্রের শেষের দিন আপনাগো বান্দার নামটা কইয়া যাই-এম আর আখতার মুকুল’Ñ এভাবেই মুকুলের কণ্ঠ ধারণ করা। শব্দের হাজারো বাক্য রসের মাঝে ১৬ ডিসেম্বর এক মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৪৬ বছর পর ২০১৭-এ নতুন করে চরমপত্রের গলার সেই বাঁশি বাজালেন স্বদেশ রায়। তিনি লিখেছেন ‘আসলে চরমপত্রকে নিয়ে লিখতে গেলে আবার আরেকটি বই লিখতে হয়। তিনি ইতিহাসের ও সাংবাদিকতার যে রাজপাটে বসে আছেন সেখানে উঠে প্রণাম করার মতো দীর্ঘ শরীর আমি আমার কাজ দিয়ে এখনও তৈরি করতে পারিনি’Ñ লেখকের হৃদয় নিংড়ানো এই বিনম্র শ্রদ্ধা ভরা ভালবাসা দিয়ে আমরা অতি সহজেই বুঝে উঠতে পারি যে, কি ধরনের আবেগ-আদর ও যতেœ তিনি সংবাদিকতায় ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রাপ্ত এম আর আখতার মুকুলের জীবনকে অলঙ্কৃত করেছেন। আখতার মুকুলের যিনি একজন অতি প্রিয় ও স্নেহভাজন, যিনি শুধুমাত্র তাঁর লেখার ভক্ত পাঠকই ছিলেন না, অনেক আড্ডার প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিলেন, তিনিই আজকের সৎ-সাহসী, নির্ভীক লেখক ও সাংবাদিক স্বদেশ রায়। যাঁর সদ্য প্রকাশিত লেখা এম আর আখতার মুকুলের শেষ পা-ুলিপিতে ফুটে উঠেছে পর্দার আড়ালের অনেক সত্য ইতিহাস। সত্যি কি ভয়ঙ্কর, সত্য ও নিদারুণ ঘটনা যা আমাদের আজ অবধি জানা ছিল নাÑ পড়তে গিয়ে গায়ে কাঁটা দেয়Ñ কত সাংঘাতিক ব্যাপার। ’৭১-এ প্রচারিত চরমপত্র ছিল মুকুলের চরমপত্রÑ দিনে দিনে তাঁর আরেক পরিচয় ঘটে চরমপত্রের মুকুল অর্থাৎ চরমপত্রের নামেই মুকুল মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। আজ ২০১৭ সালে আখতার মুকুলের চলে যাওয়ার ১৩ বছর পর নির্ভীক লেখক স্বদেশ রায় চরমপত্রের নতুন নামকরণ করেন এভাবে ‘বাংলাভাষায় এখন চরমপত্রের অর্থ অন্য কিছু হতে পারে নাÑ এর সাধারণ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বদলে অভিধানে লেখা হবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান, যার লেখক ও পাঠক ছিলেন এম আর আখতার মুকুল।’ লেখকের মনের আক্ষেপ এভাবে ফুটে উঠেছে ‘নতুন প্রজন্ম তোমরা চরমপত্র না শুনে থাকলে এখনই শোন-’ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি করেন ‘চরমপত্রের গোটা সিডিটি ইউটিউবে ছড়িয়ে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে।’ আরও একটি অতি বিস্ময়কর তথ্য জানা গেল হারিয়ে যাওয়া আখতার মুকুলের লেখা শেষ পা-ুলিপি থেকে যা সাংবাদিক এবিএম মূসার অনুরোধে এক ভয়ঙ্কর বিতর্ক সৃষ্টিকারী রচনা ‘সিক্সটি মিলিয়ন কলাবরেটর’ লিখে এনায়েতউল্লাহ খান বাংলাদেশে প্রথম রাজাকারদের একটি স্থান করে দেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রেখেছে। না, আমরা কখনই জানতে পারতাম না এই জঘন্য ইতিহাস, যদি না সাহসী লেখক স্বদেশ রায় হারিয়ে যাওয়া আখতার মুকুলের সেই অপ্রকাশিত পা-ুলিপি থেকে এই সঠিক সত্যকে প্রকাশ করতেন। এ যেন অতল আটলান্টিকের তলদেশ থেকে লেখক ঝিনুকের মাঝে মুক্তা খুঁজে এনেছেন। এক নিশ্বাসে লেখাটির প্রতিটি শব্দ- বাক্যগুলো বার বার পড়ে হৃদয়ঙ্গম করা যায় লেখকের ভাবনা-চিন্তা ও চরমপত্রের মুকুলের প্রতি তার শ্রদ্ধা-ভালবাসা ও সম্মান। যা পড়ে আখতার মুকুলের চলে যাওয়া দিনটির সব দুঃখ, কষ্ট ও মর্মপীড়া কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকা যায়।
×