ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিশুবান্ধব হাসপাতালে চিকিৎসার পরিবেশ না থাকার অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২ জুলাই ২০১৭

শিশুবান্ধব হাসপাতালে চিকিৎসার পরিবেশ না থাকার অভিযোগ

নিখিল মানখিন ॥ সরকার ঘোষিত শিশুবান্ধব হাসপাতালগুলোতে শিশু চিকিৎসাসেবার পরিবেশ না থাকার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সরকারী-বেসরকারী ৫৯২ হাসপাতালকে পুনরায় শিশুবান্ধব হাসপাতালে রূপান্তর করেছে সরকার। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া শিশু চিকিৎসাসেবার মানসম্পন্ন হাসপাতাল নেই। বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতে শিশুদের জন্য কিছুটা ব্যবস্থা থাকলেও জেলা ও উপজেলা বা থানা পর্যায়ে শিশুদের উপযোগী চিকিৎসাসেবা একেবারেই অপ্রতুল। সেখানে শিশুদের বিশেষায়িত হাসপাতালের ভাবনা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। রাজধানীতেও শিশুদের জন্য বিশেষায়িত কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া প্রায় সব বড় হাসপাতালেই পৃথক বিভাগের নামে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো দিয়ে শিশু চিকিৎসাসেবা চলে। এমন অবকাঠামো দিয়ে গড়া হাসপাতালকে শিশুবান্ধব বলা যায় না। সেবার মান আর ধরন নিয়েও রয়েছে অভিভাবকদের অভিযোগের পাহাড়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিশুবান্ধব হিসেবে সরকার ঘোষিত দেশের সরকারী ও বেসরকারী ৫৯২ হাসপাতালকে সত্যিকার অর্থে শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত চার বছরে সাত সহস্রাধিক ডাক্তার ও নার্সকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। শিশুবান্ধব হাসপাতাল হিসেবে পরিগণিত হওয়ার লক্ষ্যে হাসপাতালগুলোকে বিশেষজ্ঞরা ১৫টি নির্দেশনা পালনের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় পুষ্টি সেবার সহায়তায় বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৯২টি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালসমূহকে শিশুবান্ধব করতে প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছে। শিশুবান্ধব হাসপাতাল কর্মসূচীর আওতায় এ পর্যন্ত ৬৫টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের ৬৫০ জন, ৪১৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৪ হাজার ১৪০ জন, ৬০টি সদর হাসপাতালের ৬শ’ জন, ১৮টি সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৩৬০ জন এবং ৩৮টি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ৭৬০ জনসহ মোট ৭ হাজার ৫০ জন ডাক্তার ও নার্সকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। শিশুবান্ধব হাসপাতাল হিসেবে পরিগণিত হওয়ার লক্ষ্যে হাসপাতালগুলোকে বিশেষজ্ঞরা ১৫টি নির্দেশনা পালনের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দিয়েছেন। সেগুলো হলোÑ হাসপাতালে শিশুদের জন্য কি কি সুবিধা ও নিয়মনীতি রয়েছে তা হাসপাতালের প্রবেশপথ সাইনবোর্ড আকারে ঝুঁলিয়ে দেয়া, ডাক্তার ও নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবলের প্রশিক্ষণ, মায়েদের সন্তান প্রসবের সকল প্রকার সুবিধাদি, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, বোতলজাত ও চুষনি জাতীয় দ্রব্যাদি প্রবেশ না করতে দেয়া, ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ, ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি পুষ্টিকর খাবার, স্থানীয় জনগণকে হাসপাতাল কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও ছয় মাস পরপর শিশুবান্ধব হাসপাতালটির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানের মনিটর ও সুপারভিশন জোরদার করা। বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. এস কে রয় জানান, ১৯৯২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ৪৯৯টি হাসপাতালকে শিশুবান্ধব হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ১৯৯১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ যৌথভাবে বিশ্বব্যাপী মায়ের দুধ খাওয়ানোর গুরত্বের সঠিক প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে শিশুবান্ধব হাসপাতাল করার পদক্ষেপ নিলে সে ডাকে সাড়া দিয়ে ওই সময় প্রায় ৫০০ হাসপাতাল করা হয়। কিন্তু নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়নের অভাব ও নিয়মিত অর্থ বরাদ্দের অভাবে শিশুর ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ও ছয় মাস পর্যন্ত পরবর্তী থেকে ঘরে তৈরি খাওয়ানোর হার কম ও কৌটার দুধ খাওয়ানোর হার বৃদ্ধি পায়। তিনি জানান, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শিশুবান্ধব হাসপাতালগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশনা দিলে পর্যায়ক্রমে শিশুবান্ধব হাসপাতালে রূপান্তর করা হয় বলে জানান ড. এস কে রয়। এদিকে, শিশুবান্ধব হাসপাতালগুলোর মান নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালগুলোর সংখ্যা খুব কম। আর ওইসব বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোই তো শিশুবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর ‘ঢাকা শিশু হাসপাতাল’ সরেজমিন ঘুরে অভিযোগের বাস্তব চিত্র পাওয়া গেছে। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার বাসিন্দা মোঃ নজরুল হোসেনের পাঁচ বছরের কন্যা রোকসানা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শিশুটির বাবা-মা ভোর ৪টার দিকে তাকে নিয়ে আসেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। জরুরী বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক নিদ্রাচোখে শিশুটিকে দেখে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে ভর্তি করার দেড় ঘণ্টা পর সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের চিকিৎসক আসেন। এত পরে আসার কারণ হিসেবে চিকিৎসক বলেন, আমি একা ৩টি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছি। আমার কী করার আছে? যে ওয়ার্ডে শিশু রোকসানাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল সে ওয়ার্ডে ৬০টি বেডের জন্য দায়িত্ব পালন করছিলেন ৩ জন নার্স (সেবিকা)। শিশুটির বাবা সেবার জন্য এক নার্সকে ডাকলে তিনি খারাপ ব্যবহার করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা শিশু হাসপাতালে রোগীর তুলনায় স্টাফ (ডাক্তার ও নার্স) কম রয়েছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো অপরিষ্কার। দেয়ালের খসে পড়ছে। এছাড়াও বিছানাগুলো স্যাঁতসেঁতে। ওয়ার্ডগুলোতে বিরাজ করছে অন্ধকার ও ঘিঞ্জি পরিবেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শিশু কার্ডিওলজি ইউনিট যাত্রা শুরু করে ২০০৪ সালে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগের অবকাঠামোর তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। এখানে সঠিক যন্ত্রপাতি না থাকা এবং অপর্যাপ্ত সংখ্যক শিশু কার্ডিওলজিস্টের কারণে শিশুদের রোগ সঠিকভাবে নির্ণয়ে অনেক অসুবিধা হয়। কারণ বড় ও ছোটদের হৃদরোগের মধ্যে পার্থক্য অনেক। শিশু কার্ডিয়াক সার্জারিতে অনেক পিছিয়ে আছে দেশ। রাজধানীতে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ছাড়া অন্য কোথাও শিশু হৃদরোগীদের সার্জারি হয় না। তাই গুরুতর ও জটিল শিশু রোগীদের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশকেই যেতে হয় দেশের বাইরে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেল আড়াই বছরের মেয়ে আফসানা খাতুনের (৭) বাবা মনিরুল ইসলামের মুখে। রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকায় তার বাসা। তিনি বললেন, আমার মেয়ের চোখের সমস্যার জন্য জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে যাই। চিকিৎসক তাকে দেখে তিনদিনের ওষুধ দেন। তিনদিন পর যাই হাসপাতালের শিশু বিভাগে। গিয়ে দেখি দরজা-জানালা সব বন্ধ। প্রচ- গরমেও ভেতরে ফ্যান না থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা। ২০-৩০ সেকেন্ডের মধ্যে রোগীরা বের হয়ে আসছে চিকিৎসকের রুম থেকে। মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসকের রুমে গেলে তিনি কেবল লাইট দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দেখলেন চোখ। দেখেই টেস্ট দিয়ে রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে বললেন। চোখের কী সমস্যা জানতে চাইতেই বললেন অস্ত্রোপচার করাতে হবে। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও জানতে পারলাম না আমার মেয়ের কী সমস্যা। এর মধ্যে অন্য রোগী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন চিকিৎসক। নবজাতকদের চিকিৎসার ক্ষেত্র এখনও দেশে তৈরি হয়নি বলে মনে করেন জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ‘নবজাতকদের ব্রেইন বা কিডনির কোন রোগ হলে অভিভাবকদের ছুটতে হয় দেশের বাইরে। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তাদের দেশেই চেষ্টা করা ছাড়া বিকল্প থাকে না। কিন্তু দেশের হাসপাতালগুলোর এনআইসিইউগুলো (নিওন্যাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) এখনও অসম্পূর্ণ বলে মনে করেন অনেক চিকিৎসক। তারা বলেন, ‘এই কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি নেই। আবার নবজাতক বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বাড়লেও তাদের আরও উন্নত প্রশিক্ষণ দরকার। শিশুদের কিডনি, হৃদযন্ত্র, ক্যানসার বা অন্য রোগগুলো সম্পর্কে ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়। এ জন্য বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা হার্টের সার্জারির মতো উল্লেখযোগ্য সেবাদানে আমরা পিছিয়ে আছি। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, সারাদেশে যত শিশু রোগী আছে, তার তুলনায় হাসপাতালের সিটের সংখ্যা অপ্রতুল। আরও অনেক বেশি কিংবা বিশেষায়িত সেবার মতো স্বাস্থ্যসেবা দরকার দেশে, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। একইসঙ্গে শিশুদের সঙ্গে আচরণের জন্য যে মানের অবকাঠামো দরকার, দেশে সেটাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হাসপাতালগুলোতে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত সিট বরাদ্দ কিংবা নির্ধারিত নয়। মোট রোগীর মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা বেশি হলেও এবং শিশুদের জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বেশি দরকার হলেও এর অভাব প্রকট। জাতির ভবিষ্যত বিবেচনায় চিকিৎসাসহ অন্য খাতগুলোতেও শিশুরা অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও তা দেখা যায় না। এ কারণে দেশে শিশুদের চিকিৎসার অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়। আর যেখানে গুটি কয়েক হাসপাতাল ছাড়া শিশু চিকিৎসাসেবার জন্য পূর্ণাঙ্গ শিশুবান্ধব হাসপাতাল নেই, সেখানে দেশের ৫৯২টি হাসপাতালকে শিশুবান্ধব ঘোষণা করার বিষয়টি কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।
×