ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি সমাবেশে ঘোষণা

বাংলাদেশ সম্প্রীতির মিলনের, উগ্রবাদের ঠাঁই হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২ জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশ সম্প্রীতির মিলনের, উগ্রবাদের ঠাঁই হবে না

মোরসালিন মিজান ॥ কবি তারিক সুজাত তার কবিতা থেকে পাঠ করছিলেন। বেদনার পঙ্ক্তিমালা। হলি আর্টিজানে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্তঃসত্ত্বা মা সিমোনা মনটির অনাগত সন্তানকে ভাষা দিয়েছিলেন তিনি। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করছিলেন- জন্মের আগেই আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন/আমার কোন দেশ নেই, ভাষা নেই, জাতি নেই/ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্যের ভেদাভেদ নেই/জীবনের বিভৎস রূপ দেখে জন্মের আগেই/আমি ক্রন্দনকে গিলে ফেলেছি।/আমার প্রথম নিঃশ্বাস পৃথিবীর বায়ুম-ল/একটুও বিষাক্ত করেনি/ শেষ নিঃশ্বাসই এ পৃথিবীর কাছ থেকে পাওয়া/আমার প্রথম উপহার...। এরপর আর মানুষ হিসেবে লজ্জিত না হয়ে পারা যায়? নত মস্তকে শুনছিলেন সবাই। বিষণœ হয়ে উঠেছিল মন। ভেতরটা কাঁদছিল। এমনকি একজন সন্তানসম্ভাবা মাকে, তার গর্ভের সন্তানকে বাঁচতে দেয়া হলো না! এ কোন বাংলাদেশ? আয়নায় নিজের মুখ দেখছিল বাঙালী। কোন বাঙালী পারে এতটা নিষ্ঠুর হতে? তারিক সুজাতের কবিতা যেন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় নতুন করে। তবে শুধু কবিতায় নয়, গানে কথায় শনিবার স্মরণ করা হয় হলি আর্টিজানে নিহত স্বজনদের। এদিন বৃষ্টিস্নাত বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছিলেন সংস্কৃতি কর্মীরা। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ একাত্মতা পোষণ করতে এসেছিলেন। সবার পোশাক সাদা। ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে সকলেই শান্তির বাণী উচ্চারণ করছিলেন। আয়োজনটির নামও দেয়া হয়েছিল শান্তি সমাবেশ। ‘জঙ্গীবাদ রুখে দাঁড়ায় বিশ্বমানবের রক্তধারা’ সেøাগানে সমাবেশের আয়োজন করেছিল সাংস্কৃতিক জোট। গত বছর ২০১৬ সালের ১ জুলাই আক্রান্ত হয়েছিল গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি। রেস্তঁরাটিতে বিদেশী নাগরিকেরা রাতের খাবার গ্রহণ করছিলেন। প্রাণবন্ত আড্ডা গল্পে মেতেছিলেন বাঙালীরাও। কিন্তু কে জানত অতিথিপরায়ণ বাঙালীর কপালে এদিনই এঁকে দেয়া হবে কলঙ্ক তিলক? লজ্জায় ডুববে বাংলাদেশ, কে জানত? হলো তা-ই। অস্ত্র হাতে সেখানে প্রবেশ করল মানুষের মতো দেখতে একদল দানব। একদল উন্মাদ। ধর্মের নামে, আহা, কী নির্মম নিষ্ঠুরভাবে ওরা খুন করল মানুষ! নারী-পুরুষ এমনকি অনাগত শিশুটিকে বাঁচতে দিল না তারা। রক্তে ভেসে গেল হলি আর্টিজান। শনিবার ছিল প্রথম বার্ষিকী। বেদনাবিধূর দিনে সারাদেশের মানবিক মানুষেরা কেঁদেছেন। চোখ ভেজা ছিল সংস্কৃতি কর্মীদেরও। হলি আর্টিজানে নিহতদের একটি কোলাজ ছবি তারা স্থাপন করেছিলেন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। নির্মম হত্যাকা-ের শিকার মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল চারপাশ। এ অবস্থায় অনুষ্ঠান শুরু করেন জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। কালো দিবসটিকে জঙ্গীবাদ রুখে দেয়ার অঙ্গিকারের দিন বলে ঘোষণা দেন তিনি। এরপর নিহতদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানান। দেশের খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কর্মীরা মুঠো ভর্তি ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিতে থাকেন। এ সময় প্রখ্যাত শিল্পী গাজী আব্দুল হাকিম বাঁশিতে বিয়োগান্তক সুর তুললে ভেতরের কান্না যেন বের হয়ে আসতে চায়। একে একে ফুল দেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, আতাউর রহমান, কবি মোহাম্মদ সামাদ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রমুখ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ঢাকা আমাদের প্রিয় শহর। আনন্দের শহর। গৌরবের শহর। ভাষা আন্দোলনের শহর, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের শহর। সেই ঢাকায় ঘটে গেল এই নির্মম হত্যাকা-! একদল জঙ্গী উন্মাদ ইসলাম ধর্মের নাম করে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন বিদেশী অতিথি। আমাদের সকল ভালবাসা সহমর্মিতা ব্যর্থ হলো ওই একটি ঘটনায়। আমরা আশাহত হলাম। কিন্তু বাঙালী তো সব সময় হতাশার ভেতর থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠে। শান্তির স্বপক্ষে বাঙালী জেগে উঠেছে। আজ এই শহীদ মিনার থেকে বলছি, আমরা প্রত্যাখ্যান করি জঙ্গীবাদকে। হত্যাকে ঘৃণা করি। নিজের দেশে, নিজ দেশের মানুষ যে নৃশংসতা দেখিয়েছে তার দায় অস্বীকার করেন না সংস্কৃতিকর্মীরাও। দায় থেকেই হয়ত তিনি বলেন, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। নিহতদের স্বজনদের কাছে, সেই সব দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাই আমরা। এ সময় গুলশানে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করার আহ্বান জানান তিনি। সকলেই উঠে দাঁড়ান। টুঁ শব্দটি নেই। নিরীহ নির্দোষ মানুষগুলোর আহাজারি, যন্ত্রণার মৃত্যু যেন ভেসে ওঠে কল্পনার চোখে। নীরবতা ভাঙ্গেন কণ্ঠশিল্পী মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না। রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেন তিনি। সহশিল্পীদের নিয়ে গেয়ে যানÑ সমুখে শান্তিপারাবার/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার...। সঙ্গীতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষ হলে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সুবক্তা মফিদুল হক। এই হত্যাকা-কে অবিশ্বাস্য নৃশংসতা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ধর্মের জপমালা পাঠ করলেই কেউ ধার্মিক হয়ে যায় না। হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা তার প্রমাণ। একই উদাহরণ দিতে ১৯৭১ সালে ফিরে যান তিনি। বিশ্বের গণহত্যাগুলো নিয়ে নিয়মিত কাজ করা মফিদুল হক বলেন, ২০ শতকের সবচেয়ে বড় মুসলিম নিধনের ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশের মাটিতে। এই হত্যাকা- ঘটিয়েছিল মুসলমান নামধারী সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক সামরিক নেতৃত্ব। নানা অপবাদ দিয়ে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেন তিনি। বলেন, এক মানুষ অপর মানুষকে ধর্ম-বিদ্রোহী ধর্মত্যাগী ধর্মচ্যুত বা মুশরিক হিসেবে অভিহিত করতে পারে না। সে অধিকার কারও নেই। বাংলাদেশ সম্প্রীতির। বাংলাদেশ মিলনের। এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে উঠবে। হিংসা বিদ্বেষ ভুলে এক মানুষের বুকে অপর মানুষের জন্য ভালবাসা জাগিয়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। পেশাজীবীদের প্রতিনিধিদের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডাঃ কামরুল হাসান খান। এসেছিলেন একাত্মতা জানাতে। নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গীরা হলি আর্টিজানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত করতে চেয়েছিল। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে জঙ্গীরাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। আজও যখন আমরা শান্তি সমাবেশ করছি তখন কুষ্টিয়াতে পুলিশ জঙ্গী আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়ি ঘিরে রেখেছে। এই জঙ্গীরা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়, আমাদের ভাবতে হবে। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি রুখে দিতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিশিষ্ট অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, সংস্কৃতি সব সময় সত্য সুন্দরের পক্ষে। যারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে তাদের প্রতি আমরা আমাদের ঘৃণা জানাই। বাংলাদেশে এরা আর কোনদিন সফল হবে না বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। আলোচনার এ পর্যায়ে মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ান কবি তারিক সুজাত। হ্যাঁ, হলি আর্টিজানে হামলার পর লেখা সেই কবিতাখানি পড়ে শোনান তিনি। কবিকণ্ঠে কবিতা ঠিক নয়, চমৎকার আবৃত্তি। দৃশ্যকল্প। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনেন শ্রোতা। পরপরই কবিতায় নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন খ্যাতিমান কবি আসাদ চৌধুরী। ‘ব্রাত্যজনের কিছু ছওয়াল’ কবিতা থেকে পাঠ করে শোনান তিনি। কবিতার পর আবারও আলোচনা। এবার মামুনুর রশীদ। বিশিষ্ট অভিনেতা বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। একাত্তরে পাকিস্তানীরা মানুষ হত্যা করছিল। আমরা তখন পশু হত্যা করতে বাধ্য হয়েছি। সেটা ছিল আমাদের অধিকার। কিন্তু হলি আর্টিজানে যা ঘটেছে তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। ওই হৃদয়বিদারক ঘটনায় আমরা অভিযুক্ত হলাম। অভিযোগকারী এক বন্ধুর স্ত্রীর উদ্ধৃতি দেন তিনি। বলেন, ওই জাপানী নারী দুঃখ করে বলেছিলেন, আমি ৩৭ বছর আগে বাংলাদেশে এসেছি। বাঙালী তো এমন নয়। কী করে এরা এত নৃশংস হতে পারল? জবাবে আমি তাকে বলেছিলাম, এরা বাংলাদেশী নয়। এরা বহিরাগত। খুব ক্ষুদ্র অংশ। নৃশংস হত্যাকা-ের বার্ষিকীতে রাজনৈতিক দলগুলোর নীরবতারও সমালোচনা করেন তিনি। তাদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন, সমস্ত দায় কি শুধু সংস্কৃতিকর্মীদের? রাজনৈতিক দলগুলো আজ কোথায়? কেন তারা মাঠে নামছে না? কেন রুখে দাঁড়াচ্ছে না তারা? অভিযোগ অভিমানের এই সুর হারিয়ে যায় গানে। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের শিল্পীরা রজনী কান্ত থেকে গানÑ তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে/ তব, পুণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে...। আয়োজনের শেষের দিকে আলোচনায় অংশ নিয়ে একটি প্রস্তাব রাখেন রামেন্দু মজুমদার। হলি আর্টিজানের ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তিনি বলেন, ১ জুলাইকে সরকার জঙ্গীবাদ বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। প্রতিবছর এই দিবসে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান গাইবে বাঙালী। জবাবে সরকারের প্রতিনিধি সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এই প্রস্তাবটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করব। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শেষ হয় আয়োজনের প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়। অসংখ্যা প্রদীপের আলোয় নতুন করে জ্বলে ওঠে যেন আমার সোনার বাংলা!
×