ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর নির্দেশ ॥ জনমুখী বাজেট বাস্তবায়ন শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২ জুলাই ২০১৭

অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর নির্দেশ ॥ জনমুখী বাজেট বাস্তবায়ন শুরু

কাওসার রহমান ॥ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা নিয়ে শনিবার থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে নতুন বাজেটের। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে রেকর্ড আলোচনা-সমালোচনার পর গত বুধ ও বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে যে বাজেট পাস হয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই একটি জনমুখী বাজেটে পরিণত হয়েছে। আর ভ্যাট আইন স্থগিত, আবগারি শুল্ক পুনর্বিন্যাস ও সংযোজন শিল্পের সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করায় শেষ পর্যন্ত স্বস্তিদায়কই হয়েছে বাজেট। তবে নির্বাচনের আগে এসে এতো আলোচনা ও সমালোচনার সুযোগটা দেয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা আশঙ্কা করছেন, দুই বছরের জন্য মূল্য সংযোজন কর আইন স্থগিত করায় তা আগামী নির্বাচনে ভোটের একটি ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এছাড়া ভ্যাট আইন স্থগিত করায় রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে একটি শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখতে গিয়ে যেন জনগণের ওপর পরোক্ষ কর আরোপ করা না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। একই সঙ্গে দুই বছর পর যখন ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়ন করা হবে, তখনকার উপযোগী করে এর প্রস্তুতিও যেন ঠিকমতো রাখা হয় এবং সংস্কার কার্যক্রমও যেন অব্যাহত থাকে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শঙ্কা নিয়ে শনিবার (১ জুলাই) থেকে কার্যকর শুরু হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। এ বছর বাজেটের আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের অনেকগুলো বিষয় জনমনে স্বস্তি এনে দেবে। বিশেষ করে ভ্যাট আইনটি দুই বছরের জন্য স্থগিতের সিদ্ধান্তটি অনেকটা স্বস্তিদায়ক। এছাড়া, আবগারি শুল্কের হার পুনর্বিবেচনার বিষয়টিও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এখন সঞ্চয়পত্রের সুদ হার পরিবর্তনের বিষয়ে সরকারকে একটি ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে মানুষ যেন সঞ্চয় প্রবণতা হারিয়ে না ফেলে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্বিবেচনার বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব না থাকলেও অর্থ বিল-২০১৭ পাসের আগে দেয়া বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনন্তকালের জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নির্দিষ্ট থাকতে পারে না।’ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘অর্থমন্ত্রী ব্যাংক আমানতের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্কের পুনর্বিন্যাস করেছেন, তাতে জনগণ উপকৃত হবেন। এতে জনগণ সঞ্চয়ের আগ্রহ হারাবেন না। তা না হলে জনগণ তো সঞ্চয়ের আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলতেন। তবে এখন সরকারের দায়িত্ব হবে বিষয়টি মনিটরিং করা। আর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যদি কমাতেই হয়, তাহলে তা যেন বেদনাদায়ক না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। বেশি পরিমাণ কমানো ঠিক হবে না। কারণ, এখানকার আয় দিয়ে অনেকে সংসার চালান। তবে ধনবানরা যাতে এখানে সুযোগ না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’ বাজেট নিয়ে জনগণের মধ্যে স্বস্তি এলেও স্বস্তিতে নেই রাজস্ব সংগ্রহকারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কারণ যে ভ্যাটের ওপর ভর করে চার লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের হিসাব সাজিয়েছেন অর্থমন্ত্রী এখন ভ্যাট দুই বছরের জন্য স্থগিতের কারণে রাজস্ব ঘাটতি সামলে বাজেট বাস্তবায়ন অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে রাজস্ব ঘাটতি পূরণে সরকারের সামনে করজাল সম্প্রসারণের বিকল্প থাকবে না। আর সেই চাপ সামাল দিতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে। চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব অপরিবর্তিত রেখেই গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে। সেখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ অংকের হিসেবে বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসবে বলে ধরা হয়েছে। গতবছরের ভ্যাট আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে নতুন বাজেটের ওই লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার পরিকল্পনা ছিল, ২০১২ সালের ভ্যাট আইন ১ জুলাই থেকেই কার্যকর হবে এবং তার ফলে পণ্য বিক্রি ও সেবায় অভিন্ন হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে। কিন্তু ভ্যাট আইন ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকরের কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের প্রবল বিরোধিতায় তা এক বছর পেছানো হয়। এবার অর্থমন্ত্রী অটল থাকার কথা বললেও বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কা এবং নির্বাচনের দেড় বছর আগে ভোটের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে শেষমেশ সরকার পিছু হটে। গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে অর্থমন্ত্রী তার অর্থবিলে সংশোধনী আনেন। এতে ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন অন্তত দুই বছরের জন্য ঝুলে যায়। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, বাজেট পাসের আগে গত ২২ জুন এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেই নির্বাচনের আগে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী দুই বছরের জন্য ভ্যাট আইন স্থগিত করার নির্দেশ দেন। এ অবস্থায় ১৯৯১ সালের চলতি ভ্যাট আইনটিই বলবৎ থাকবে। তবে এর সঙ্গে নতুন ভ্যাট আইনের অনলাইন ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে। ওই বৈঠকে বাজেট ঘাটতি পূরণেও একটি গাইডলাইন দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পুরনো আইনের সঙ্গে অনলাইনে ভ্যাট প্রদানের ব্যবস্থা কার্যকর হলে আরও রাজস্ব আদায় বাড়বে। এছাড়া রাজস্ব ঘাটতি পূরণে করজাল সম্প্রসারণ করতে হবে। তারপর রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার যে ঘাটতি থাকবে তা পূরণে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেবে। সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটেও ব্যাংকিং খাত থেকে কোন ঋণ গ্রহণ করেনি। আগামীতে প্রয়োজন হলে এ খাত থেকে ঋণ নিতে পারবে সরকার। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবছর স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব আদায় বাড়ছে। নতুন অর্থবছরেও গতবছরের চেয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি ভ্যাট আদায় হবে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই, এরকম আরও প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনা গেলে এবং অনলাইনে ভ্যাট আদায় করা গেলে সেখান থেকে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে। তারপরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থেকে যাবে। এই ঘাটতি সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পূরণ করতে পারে। তারপরও ঘাটতি থেকে গেলে বাজেট সংশোধনের সময় লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করতে হবে। এছাড়া সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ও কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে গিয়ে যেন সরকারকে জনগণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা আরোপ করতে না হয়। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে রাজস্ব হয়তো বাড়ত। এটি কার্যকর না হওয়ায় রাজস্ব আদায় কমবে। এ জন্যই সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. ফরাসউদ্দিন বলছেন, ‘আগের ভ্যাট আইন আছে, সেটা দিয়ে ভ্যাট আদায় হচ্ছে। নতুন আইনে অনেক ছাড় দেয়ার বিষয় ছিল। সেটা থাকবে না। সরকারকে নতুন নতুন ক্ষেত্র বের করে আদায় বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা ২৮ লাখের বেশি। বাস্তবে করযোগ্য মানুষের সংখ্যা কোটির বেশি। কিন্তু কর দেন ১২ থেকে ১৪ লাখ মানুষ। অর্থাৎ, এখানে কর আদায় বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। এনবিআরের প্রতি তার পরামর্শ হলো, কর আদায় আরও সহজ করে এর আওতা বাড়াতে হবে। যারা বিদ্যমান কাঠামোতে করযোগ্য হয়েও তা দিচ্ছেন না, তাদের করজালে আনতে হবে। তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়বে। জানা যায়, সবক্ষেত্রে অভিন্ন ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করতে না পারায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এখন বিদ্যমান প্যাকেজ ভ্যাটের আওতায় আরও সম্প্রসারণ করতে যাচ্ছে। এছাড়াও আয়কর আদায়ের ওপর জোর দিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এক্ষেত্রে নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সাহস যোগাচ্ছে সদ্য সমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে টানা তৃতীয় বারের মতো রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। এনবিআর সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে তা সংশোধন করে ১ লাখ ৮৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত (সাময়িক) ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। আগামী ২৫ জুলাই চূড়ান্ত রাজস্ব বিবরণী পাওয়া গেলে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘লক্ষ্যমাত্রা’ নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা, সন্দেহ আর হতাশার মধ্যেও রেকর্ড গড়ে টানা তৃতীয়বারের মতো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছি আমরা। স্বাধীনতার পর লক্ষ্যমাত্রার রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করেছে এনবিআর। বর্তমান গতিশীলতা ধরে রাখলে নতুন অর্থবছরেও বাজেটের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। তবে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিশাল ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক সাহায্য থেকে অর্থ সংগ্রহের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে এমনিতেই বাজেট সংশোধন করতে হবে। কারণ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে যে সকল প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে বলে ধরা হয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে না। কারণ এতো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে না। আবার পাওয়া গেলেও তা খরচ করতে পারবে না। ফলে এননিতেই বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর প্রকল্প কাটছাঁট করতে হবে। এবার বাজেটে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হয়েছে, যা মেটানোর জন্য বৈদেশিক ঋণ থেকে সাত বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কখনই তিন থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে বিদেশ থেকে টাকা পেলেও এক বছরের মধ্যে সাত বিলিয়ন ডলার ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতি দেশে তৈরি হয়নি।
×