ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশানে নিহত ৬ জঙ্গীর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হস্তান্তর

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২ জুলাই ২০১৭

গুলশানে নিহত ৬ জঙ্গীর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হস্তান্তর

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ এক বছর পর হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় অভিযানে নিহত ৬ জঙ্গীর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক বিভাগ তা তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ফরেনসিকের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জনকণ্ঠকে জানান, দেড়টার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হলি আর্টিজানে নিহত ৬ জনের লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত বছর ২ জুলাই বিকেলে মৃতদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। সোহেল মাহমুদ জানান, নিহত ছয় জনের প্রত্যেকের শরীরে গড়ে দুই থেকে তিনটি গুলির আঘাত পাওয়া গেছে। দু’জনের শরীরে ছিল বোমার আঘাত। এছাড়া একজনের বাঁ হাত ও গালে বোমা বিস্ফোরণের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে এই চিহ্নগুলো আত্মঘাতী বোমার আঘাত থেকে নাকি পুলিশের ছোঁড়া বোমার আঘাত থেকে হয়েছে, তা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দিতে এক বছর সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ জানান, আমাদের কাছ থেকে এফবিআই ও ভারতের একটি সংস্থা কিছু নমুনা নিয়েছিল। আমরা সেগুলোর প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তাদের প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি। পরে গত বৃহস্পতিবার আমরা নিজেদের প্রতিবেদন সম্পন্ন করেছি। শনিবার কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেছি। হামলার আগে জঙ্গীরা কোন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল মাহমুদ জানান, পাঁচ-ছয় জন মিলে এতগুলো মানুষ হত্যা করল। তারা কোন ধরনের নেশাজাতীয় পদার্থ নিয়েছিল কিনা। তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। আমাদের কেমিক্যাল এক্সপার্ট রিপোর্টে এ ধরনের কোন ড্রাগ বা উত্তেজক পদার্থ নেয়ার প্রমাণ মেলেনি। হামলাকারী জঙ্গীরা হচ্ছে, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। ওই হামলায় নিহত সন্দেহভাজন জঙ্গী হিসেবে সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সাইফুল হলি আর্টিজানের শেফ হিসেবে কর্মরত ছিল। এর আগে চলতি বছরের ১৯ জুন হলি আর্টিজানে হামলায় নিহত ২০ জনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। ওই নিহতদের শরীরে কী ধরনের আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ব্যাপারে সোহেল মাহমুদ জানান, তাদের শরীরে গুলির আঘাত ছিল, কোপানোর আঘাত ছিল। গলা কেটেও হত্যা করা হয়েছে কয়েকজনকে। কারও কারও বুক ও পেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করার চিহ্ন রয়েছে। নারীদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন বেশি ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সে সময় নিহত ৬ জঙ্গীর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়নি। সম্প্রতি এই মামলার অগ্রগতি নিয়ে কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোঃ মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, হলি আর্টিজানে হামলার তদন্ত পূর্ণাঙ্গরূপে শেষ করতে এ প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তবে চলতি বছরই অভিযোগপত্র দেয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। অতি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, হলি আর্টিজানের ঘটনায় শীঘ্রই নির্ভুল ও নিখুঁত চার্জশীট আদালতে দাখিল করা হবে। তিনি জানান, সে দিনটি আমাদের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আমরা বুঝতে শিখেছিলাম, জঙ্গীরা কী চায়, কী তাদের উদ্দেশ্য, তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা কারা, কারা অর্থায়ন করছে। সবকিছুই খুব সূক্ষ্মভাবে দেখা হচ্ছে। এ কারণে অভিযোগপত্র দিতে একটু সময় নিচ্ছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আমরা নির্ভুল অভিযোগপত্র দেব। কোন ত্রুটি ছাড়া অভিযোগপত্র দেয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছি। শীঘ্রই অভিযোগপত্র দিতে পারব। হামলার পরদিন গত বছর ২ জুলাই হামলাকারীদের মৃতদেহ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার ঘটনার ৩০ জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতজন হামলাকারীর বলে ধারণা করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এদের মধ্যে ছয়জনকে সিএমএইচে। বাকি একজন শাওনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে। হামলাকারী ছয়জনের লাশের শরীরের বোমার স্পিøন্টারের চিহ্ন ছিল। যা বোমা বিস্ফোরণে হয়েছে বলে মনে হয়েছে। আবার গুলির চিহ্নও ছিল। তিনি জানান, তাদের লাশ হিমাগারে রাখা হয়েছে। এরপর গত বছর ১১ জুলাই নিহত ৬ জঙ্গীর ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। একই সঙ্গে ছয় জঙ্গীর অস্থি-মজ্জা, রক্তমাখা জামাকাপড় আলামত হিসেবে জব্দ করার আবেদন করা হয়েছে। আদালত তা মঞ্জুর করে। সে সময় পুলিশের অপরাধ তদন্ত ও তথ্য প্রসিকিউশন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার আমিনুর রহমান জানান, মামলার তদন্তের স্বার্থে মৃত ছয় জঙ্গীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের দেহের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অস্থি-মজ্জা সংরক্ষণের আবেদন করা হয়েছে। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের আবেদন করা হয়েছে। রক্ত, চুল ও জামাকাপড় আলামত হিসেবে জব্দ করার আবেদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গুলশান হামলার ঘটনার ৪২ দিন পর গতবছর ২২ সেপ্টেম্বর সিএমএইচ হিমাগার থেকে ওই ছয় জঙ্গীর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে জুরাইন কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছিল। একনজরে গুলশান হামলাকারীদের পরিচয় নিবরাস ইসলাম নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। সে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাস ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসেসের কোষাধ্যক্ষ ছিল। ধনী পরিবারের সন্তান নিবরাস ইসলাম পড়ালেখা করেছে ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। মোনাসে ভাল না লাগায় দেশে ফিরে নিবরাস ভর্তি হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওয়ারি আর উত্তরায় বাড়ি আছে তার ব্যবসায়ী বাবার। নিবরাসের তিন চাচার মধ্যে একজন সরকারের উপ-সচিব, একজন পুলিশ কর্মকর্তা, আরেকজন বিজ্ঞানী। মীর সামেহ মুবাশ্বের ও রোহান ইমতিয়াজ দুজনেই স্কলাসটিকা স্কুলের সাবেক ও বর্তমান ছাত্র। মুবাশ্বেরের বাবা মীর হায়াত কবির এ্যালকাটেল-লুসেন্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তা। মা খালেদা পারভীন সরকারী কলেজের শিক্ষক। বড় ভাই পড়ছেন কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুবাশ্বের ‘এ লেভেল’ পরীক্ষার আগে গত মার্চে নিখোঁজ হয়। রোহানের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক, বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এবং বাংলাদেশ সাইক্লিস্ট ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি। ২০ বছর বয়সী রোহান স্কলাসটিকা শেষ করে পড়ছিল ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। তার মাও নামী ওই স্কুলের শিক্ষক। শফিকুল ইসলাম ও খায়রুল ইসলাম উভয়ের বাড়ি বগুড়ায়। এর দু’জন অবশ্য বাকিদের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নয়। গুলশান হামলার ঘটনায় আহত হলি আর্টিজানের দুই পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও জাকির হোসেন শাওনকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। তাদের জঙ্গী হিসেবে সন্দেহ করছে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত সংস্থা।
×