ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

এগিয়ে যাক দেশীয় ফ্যাশন

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২ জুলাই ২০১৭

এগিয়ে যাক দেশীয় ফ্যাশন

দেশের অনেক ক্রেতার পছন্দের তালিকায় কিরণ মালা, পাখি, রাশি, গোপী, কটকটি এমন বাহারি নামে জনপ্রিয়তা পাশ কাটিয়ে আবহমান বাংলার চিরায়ত সভ্যতা-সংস্কৃতির রঙে-ঢঙে বর্ণিল বাহারি ডিজাইন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় ফ্যাশন শিল্প। দেশীয় স্বকীয়তায় আপন সংস্কৃতি ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক দেশীয় ফ্যাশন হাউস। আমরা গর্ব করে বলতেই পারি, এক সময়ের ঘরোয়া বা শৌখিন বুটিক হাউসগুলো মেধা-মননে দেশীয় সভ্যতাকে ধারণ করে রূপ নিয়েছে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডে। বাংলার ষড় ঋতুর আবেশ পাওয়া যায় এখন দেশীয় ফ্যাশনেবল পোশাকেও। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত, বসন্ত সব ঋতুর রং-রূপ পাওয়া যাচ্ছে ফ্যাশন হাউসগুলোর সৃজনশীল প্রয়াসের প্রতিফলন হিসেবে। আছে আধুনিক সময়ের সঙ্গে বুননের অন্তমিল। পোশাক পরিধানে আরাম আয়াশের বিষয়গুলোও বাদ যাচ্ছে না। তার মানে এই শিল্পে জ্ঞান গবেষণা চলছে নিরন্তর। তাই সময় আর রুচিবোধের পালাবদল ঘটিয়ে বিকশিত হচ্ছে আমাদের দেশীয় ফ্যাশন শিল্প। শৈল্পিক বিপ্লবের সূত্রপাত যারা এক সময় কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন পোশাকে-ফ্যাশনে দেশীয় চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে, তাদের দেখানো পথ ধরে ফ্যাশন জগতে শৈল্পিক বিপ্লবের সূত্রপাত। ফ্যাশন হাউসগুলোর নানা মাত্রিক উদ্যোগের ফলে দেশের মানুষের পোশাক কেনার অভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগে শুধু ঈদ-পূজায় কেনাকাটা হলেও এখন- বাংলা নববর্ষ, মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ফাল্গুন-বসন্তসহ দিবস ও উৎসব উপলক্ষ কেন্দ্রিক পোশাক কেনার প্রবণতা বেড়েছে। জানা গেছে- বর্তমানে প্রায় শতাধিক ব্র্যান্ডের ফ্যাশন হাউস তাদের স্বনামে নিজস্বতায় শিল্পমাত্রা ঠিক রেখে দেশীয় ফ্যাশন শিল্পকে উজ্জ্বল দিগন্তে ধাবিত করেছেন। ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, এক দশক আগে দেশীয় ফ্যাশনের বাজার ছিল এক হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে ফ্যাশন বাজার বিকশিত হয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বলা যায় দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ধারণ করে দেশীয় কাপড়, দেশীয় বুনন, রং ও নক্সার বৈচিত্র্যে এসব পোশাক উৎসব-পার্বণকে সঙেগ করে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এক সময়ের ঘরোয়া বা শৌখিন আঙ্গিকে গড়ে ওঠা ছোট বুটিক হাউসগুলো সময়ের বিবর্তনে নামী-দামী ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে। উল্লেখ করা যেতে পারে আড়ং, অঞ্জনস, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রং, নগরদোলা, সাদাকালো, প্রবর্তন, শ্রদ্ধা, বাংলার মেলা, অন্য মেলা, নিপুণ, নবরূপা, গ্রামীণ চেক, নীলাঞ্জনা, ওজি, বিবিআনা, দেশালসহ আরও শ্রুতিমধুর অনেক নাম। আশার খবর হলো- এদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরেও বিস্তৃতি ঘটিয়ে রফতানি শুরু করেছে। ছোট বড় মিলিয়ে দেশে এখন ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। বছরে টার্নওভার ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। ফ্যাশন এন্টারপ্রেনিউয়ারস এ্যাসোসিয়েশন-ফিয়াবের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ লোক এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। যারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন উৎসবে সরবরাহ করে থাকেন নিত্য নতুন পোশাক। দেশীয় ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে সব বয়সী মানুষের। বিশেষত তরুণদের অধিক আগ্রহই এ শিল্পের প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারপরও সত্যি হলো- ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে ধারণের পাশাপাশি গুণগতমানে দেশীয় ফ্যাশনগুলো এগিয়ে থাকলেও প্রচারণায় অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশের সিরিয়াল, সিনেমা বা নায়ক-নায়িকাকেন্দ্রিক ফ্যাশনের প্রচার-প্রচারণায় আকৃষ্ট হচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। প্রশ্ন হলো এমন প্রচারণার সুযোগ কি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অসম্ভব? আমাদের দেশের নামী-দামী ফ্যাশন হাউসগুলো চাইলেই পারে আমাদের নাটক নির্মাতা বা অনুষ্ঠান নির্মাতাদের সঙ্গে থিমনির্ভর নাটক ও অনুষ্ঠান তৈরি করতে। এধরনের অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে অপেক্ষাকৃত কম খরচে প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ফ্যাশন সচেতনতায় ফ্যাশন প্রতিযোগিতা আয়োজন হতে পারে। হতে পারে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দেশীয় ফ্যাশন উৎসব ও মেলা। আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি হিমুর মাধ্যমে হলুদ রঙের পাঞ্জাবির বাজার সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই কোন কিছুকেই অসম্ভব বলা যাবে না। আমাদের দেশের জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান যুথবদ্ধ হয়ে দেশীদশ নামে পৃথক একটি ধারা সৃষ্টি করেছে। এরকম উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন হতে পারে মোবাইল ফ্যাশন শপ/আউটলেটের মাধ্যমে। গাড়ি নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রচারণার পাশাপাশি বিক্রয় এবং স্থায়ী বাণিজ্যের ভিত গড়ে উঠতে পারে। পত্রিকাগুলোর সঙ্গে ফ্যাশন বা লাইফস্টাইল পাতা, ছোটদের পাতা ইত্যাদির সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের আয়োজন করা যেতে পারে। তাহলেই সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশীয় ফ্যাশন শিল্পের প্রতি। আমাদের দেশীয় ফ্যাশন শিল্পের বিকাশে প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী সমন্বিত উদ্যোগ। স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণ। তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান, দেশের প্রতি ভালবাসা নিয়ে বিদেশী বাহারি নামের পোশাক পরিহার করে দেশীয় ফ্যাশনে আমাদের নিজস্ব পোশাক কিনুন, পরিধান করুন, উপহার দিন।
×