ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীতে প্রযুক্তি পড়ে আছে ॥ অভাব উদ্যোক্তার

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২ জুলাই ২০১৭

রাজশাহীতে প্রযুক্তি পড়ে আছে ॥ অভাব উদ্যোক্তার

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণাগারে (বিসিএসআইআর) সহজলভ্য কাঁচামালভিত্তিক শিল্প-কারখানায় উদ্ভাবনের তালিকা বৃদ্ধি পেলেও উদ্যোক্তার অভাবে পড়ে আছে অধিকাংশ প্রযুক্তি। এতে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে স্থানীয় কাঁচামালভিত্তিক শিল্প এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ আলোর মুখ দেখছে না। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গবেষণাগারটিতে শিল্পে ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে। বিসিএসআইআর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার ৪৯ বছরে গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা ১৬৮টি ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া প্রতিবছরই চার থেকে পাঁচটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে। সব প্রযুক্তি বাজারজাতের জন্য প্রস্তুত থাকলেও উদ্যোক্তাদের কাছে ইজারা দেয়া গেছে মাত্র ৩৫টি, যা মোট উদ্ভাবনের ৫ ভাগের ১ ভাগ। গবেষণাগার বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাজশাহী অঞ্চলে শিল্প-কারখানার বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে। তবে আগ্রহী উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে উদ্যোক্তা পাওয়া গেলেও উদ্ভাবিত পণ্যের মধ্যে যেগুলো ইজারা দেয়া গেছে, তার অধিকাংশই এ অঞ্চলের বাইরের উদ্যোক্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাজশাহী গবেষণাগারের বিজ্ঞানী ড. মঈন উদ্দীন বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে উদ্যোক্তা পাওয়া গেছে মাত্র তিনজন। বগুড়ার এক উদ্যোক্তা, যিনি কসমেটিকস সামগ্রীর একটি প্রযুক্তি ইজারা নিয়েছেন। এছাড়া রাজশাহীর মুনলাইট হেলথ এ্যান্ড হাইজিন প্রাইভেট লিমিটেড কসমেটিকস সামগ্রী ইজারা নিয়েছে ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিএম ট্রেডার্স নামের এক প্রতিষ্ঠান ইজারা নিয়েছে ওষুধজাতীয় সামগ্রীর প্রযুক্তি। এছাড়া ৩৫টি পদ্ধতির অন্য প্রযুক্তিগুলো ঢাকা ও পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পোদ্যোক্তারা ইজারা নিয়েছেন। ড. মঈন উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন জটিলতায় উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ইজারা নিতে আগ্রহী করে তোলা যাচ্ছে না। এছাড়া কিছুটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও আছে। যেমন প্রথমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো প্রধান কেন্দ্রে পাঠাতে হয়। এরপর সেখান থেকে ইজারা দেয়া হয় ওই প্রযুক্তি। তাই স্থানীয়ভাবে কোন উদ্যোক্তার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারেন না। অনেক সময় উদ্যোক্তা পাওয়া গেলেও স্থানীয়ভাবে কোন উদ্যোক্তাকে প্রযুক্তি ইজারা দেয়ার এখতিয়ার স্থানীয় বিজ্ঞানী বা প্রধানের নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তি ইজারার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা না থাকলে উদ্যোক্তা বাড়ানো যেত। এছাড়া এ অঞ্চলের মানুষ কৃষিজীবী হওয়ায় তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতি ঝোঁক কম। এজন্যও উদ্যোক্তা পাওয়া যায় না। অন্যদিকে শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারে উদ্ভাবিত প্রযুক্তির বাজারজাতের অনুমতি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) দিতে চায় না। রাজশাহীর মুনলাইট হেলথ এ্যান্ড হাইজিন প্রাইভেট লিমিটেডের প্রধান সমন্বয়ক ও বিসিএসআইয়ের সাবেক গবেষক আব্দুস সবুর বলেন, শিল্পোদ্যোক্তারা অনেক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হলেও নানা জটিলতায় পরবর্তীতে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, বিসিএসআইআর থেকে উদ্ভাবিত পণ্য নিজেদের তালিকায় না থাকায় বাজারজাতে অনুমোদন দিচ্ছে না বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের জন্য বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন সরকারী দফতরের অনুমোদন সবচেয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করে। তবে বিসিএসআইআর উদ্ভাবিত সব পণ্যের বাজারজাতে এসব দফতরের সহযোগিতা পেলে সমস্যা থাকবে না। বিএসটিআই রাজশাহীর পরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, শিল্পে বাধা প্রদান নয়, মানসম্মত পণ্য যাতে সবাই পায় সেজন্য বিএসটিআইয়ের একটি তালিকা রয়েছে। সে তালিকা অনুসারে পণ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। তবে কোন পণ্য তালিকার বাইরে থাকলে এবং সঠিক মানের না হলে সেগুলো তো বিএসটিআই অনুমোদন দেবে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্যোক্তা হাকিম আশরাফুল ইসলাম বলেন, সহজশর্তে ও কম খরচে যাতে উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হন, সেদিক খেয়াল রেখে উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বাড়বে তেমনি ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানাও গড়ে উঠবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারে শিল্প-কারখানার ব্যয় খুব কম হয়। সাধারণত একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে ইজারা বাবদ যে অর্থ দিতে হয়, তার বাইরে শিল্প প্রতিষ্ঠানভেদে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে করতে হয়। নিজস্ব অর্থায়নে শিল্পপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করতে হয় ইজারা গ্রহণকারীকে। তবে যাবতীয় পরামর্শ দেন গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা। বিসিএসআইআরের পরিচালক বিজ্ঞানী ড. হুসনা পারভীন নূর বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তাসহ যথেষ্ট সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিসিএসআইআরের প্রধান কেন্দ্র থেকে যথাযথ পদক্ষেপ প্রয়োজন। কারণ বিজ্ঞান ও গবেষণাগার শুধু রাজশাহী নয়, সব মিলিয়ে হাজারখানেক প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে। তবে সেগুলো বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে না। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার ও দেশীয় বিজ্ঞানীদের প্রতি আস্থা রেখে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। দেশের উত্তরাঞ্চলের সহজলভ্য কাঁচামালভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্থানীয় কাঁচামালের যথাযথ ব্যবহার, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কাজ শুরু করে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার রাজশাহী শাখা।
×