ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রমেকের হিমঘরে ৪ বছর ধরে পড়ে আছে চার লাশ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২ জুলাই ২০১৭

রমেকের হিমঘরে ৪ বছর ধরে পড়ে আছে চার লাশ

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ৩০ জুন ॥ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (রমেক) হিমঘরে প্রায় ৪ বছর ধরে পড়ে আছে চারটি লাশ। তার মধ্যে তিনটি লাশই বেয়ারিশ। লাশের দু’জন দাবিদার হওয়ায় আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। মেয়ের লাশ নিয়ে সৎকার করতে চেয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের বাবা, অপরদিকে পুত্রবধূর লাশ নিয়ে দাফন করতে চেয়েছেন মুসলিম শ্বশুর। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার বামনিয়া এলাকার অক্ষয় কুমারের মেয়ে নীপা রানী। এতদিনেও বেওয়ারিশ লাশগুলো দাফনের কোন ব্যবস্থা নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে লাশঘরের সব ফ্রিজ নষ্ট থাকায় লাশগুলো কংকাল হয়ে গেছে। দেখে চেনার কোন উপায় নেই কোন্টা কার লাশ। ওয়ার্ড মাস্টার মাহমুদ হোসেন জানান, নীপার লাশ চার বছর ধরে আর বেওয়ারিশ তিনটি লাশ দুই বছরের বেশি সময় ধরে আছে। তবে নীপার লাশ নিয়ে মামলা চলায় এবং বাকি লাশগুলো স্বজনরা এসে যাতে শনাক্ত করতে পারে এ কারণে রাখা হয়েছিল। নীপা রানীর পার্শ্ববর্তী বোরাগাড়ি গ্রামের জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমায়ুন কবীর রাজুর সঙ্গে প্রেম ছিল। ২০১৩ সালে নীপা রানী তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে নীলফামারী শহরে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে করে। পরে তারা বিয়ে করেন। এ বিয়ের বিষয়টি মেনে নেননি নীপার বাবা অক্ষয় কুমার। তিনি এ ঘটনায় অপহরণ মামলা করেন। পুলিশ রাজুকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠালে তিনি জোর করে নীপা রানীকে বাড়িতে নিয়ে যান। এর কিছুদিন পর রাজু জামিনে মুক্তি পায়। এর মধ্যে নীপা বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে তার লাশ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছে। অন্যদিকে প্রেমিকার মৃত্যুর খবর শুনে ৫৩ দিনের মাথায় রাজুও বিষ পান করে আত্মহত্যা করে। এর পর নীপার লাশ নিয়ে শুরু হয় দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব। নীপা রানীর বাবা অক্ষয় কুমার তার মেয়ের লাশ দাবি করে আদালতে মামলা করেন। অন্যদিকে তার স্বামী রাজুর বাবা জহুরুল ইসলামও পুত্রবধূর লাশ দাবি করেন। এ মামলা এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। ফলে মামলার নি®পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লাশ কার জিম্মায় দেয়া হবে তা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি । ওয়ার্ড মাস্টার মাহমুদ হোসেন বলেন, নীপার বাবা ও রাজুর বাবা দুজনেই লাশ দাবি করছেন। আদালতের সিদ্ধান্ত ছাড়া কাউকেই লাশ দেয়া যাবে না। এদিকে ডেড হাউজের সব ফ্রিজ নষ্ট থাকায় লাশগুলো কংকাল হয়ে গেছে। এখন লাশগুলো শনাক্ত করার উপায় নেই। সরেজমিন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে ৩টি বেওয়ারিশ লাশের মধ্যে একজন নারী ও দুজন পুরুষ। এর মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল ২০১৫ সালে এক ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হন। ৩ মে ২০১৫-এ তিনি মারা যান। ওই ব্যক্তির কোন নাম-ঠিকানা না থাকায় হাসপাতালের ডেড হাউজে তার লাশ রেখে দেয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর এক নারী হাসপাতালে ভর্তি হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার লাশও বেওয়ারিশ হিসেবে ডেড হাউজে রেখে দেয়া হয়। অন্য লাশটি কবে থেকে ডেড হাউজে পড়ে আছে তার দিন-তারিখ-সাল কিছুই বলতে পারেনি হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টারসহ সর্দার অফিস। নীলফামারী জজ আদালতের পিপি অক্ষয় কুমার মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় হিমঘরে নীপার লাশ পড়ে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, মামলা সংক্রান্ত জটিলতা ও দুই পরিবারের জেদাজেদির কারণে লাশ প্রায় সাড়ে তিন বছর রমেক হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে আছে। তিনি দীর্ঘ দিন হয়ে যাওয়ায় রমেক হিমঘরে লাশ ঠিকভাবে আছে কিনা এ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। ছেলের বাবা জহুরুল ইসলাম জানান, নীলফামারী আদালতে নীপা এফিডেভিট করে মুসলিম হয়ে তার ছেলেকে বিয়ে করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তারা দুজনই মারা গেছে। তিনি তার পুত্রবধূর লাশ দ্রুত দাফনের অনুমতি চান। ডোমার উপজেলার বামনিয়া ইউনিয়য়ের ওয়ার্ড সদস্য খুরশিদ আলম তিতাস ও বোদাগাড়ী ইউপি সদস্য রাশেদুজ্জামান জানান, আইনী জটিলতায় প্রায় সাড়ে তিন বছর লাশ হিমঘরে পড়ে থাকাটা দুঃখজনক। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মউদুদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ মাসেই এখানে যোগদান করেছেন। লাশগুলো কেন দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। কাগজপত্র দেখে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
×