ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শান্তিনগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সফলতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নাজিম উদ্দিন রোডে একটি প্রকল্প নিয়েছে ডিএসসিসি

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সুখবর নেই

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২ জুলাই ২০১৭

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সুখবর নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোন সুখবর নেই। ড্রেন, নর্দমা পরিষ্কার, সংস্কার ও নির্মাণের জন্য কিছু বরাদ্দ থাকলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। তবে সংস্থা দুটির মধ্যে শুধু শান্তিনগরের জলাবদ্ধতা ইস্যুতে দক্ষিণ সিটির কিছুটা সফলতা রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সংস্থাটি পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে আরও একটি প্রকল্প নিয়েছে। এছাড়া নতুন করে নেয়া হচ্ছে না বড় ধরনের আর কোন প্রকল্পও। ফলে শুধু পরিকল্পনা আর আশ্বাসেই আটকে আছে দুর্ভোগে জর্জরিত নগরবাসী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে শান্তিনগর ছিল অন্যতম। বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় হাঁটুপানির সৃষ্টি হতো। দীর্ঘ সময় শেষেও এই পানি অপসারণ হতো না। এ অবস্থায় বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে দক্ষিণ সিটি। ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমে শান্তিনগরের জলাবদ্ধতা প্রায় ৮০ ভাগ কমে গেছে। মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষে হলে শান্তিনগরের জলাবদ্ধতার পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে, এমন আশা করছেন দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা। সংস্থার জরিপে বর্তমানে ডিএসসিসির কিছু সংখ্যক এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকে। এর মধ্যে পূর্ব জুরাইন থেকে ডিএনডি বাঁধ পর্যন্ত এলাকায় বছরের প্রায় প্রতিদিনই পানি জমে থাকে। এই এলাকাটি অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক নিচু হওয়ায় আশপাশের এলাকাসহ বাসা বাড়ির স্যুয়ারেজের পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এছাড়া বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে মতিঝিলের কিছু এলাকা, পুরান ঢাকা ও নাজিম উদ্দিন রোডে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা নাজিম উদ্দিন রোডের জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আগস্টের মধ্যেই এর কাজ শুরু হবে। এর পর আর কোন জলাবদ্ধতা থাকবে না। শান্তিনগরে এবছর ৮৫ ভাগ জলাবদ্ধতা কমে গেছে। এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য এলাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নগরীতে ভারিবর্ষণ হলে ডিএসসিসির মতিঝিল এলাকায় কিছুটা জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘শান্তিনগরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মতিঝিলে আরও একটি প্রকল্প হাতে নিতে পারি কিনা তা চিন্তাভাবনা করছি।’ ডিএনসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে তার সংস্থা থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩১০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার এবং ২৩৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ জন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক জেট এ্যান্ড সাকার মেশিনও কেনা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বংশাল সুরিটোলা এলাকায় মেশিনটি দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার কাজের উদ্বোধনও করেন তিনি। ডিএসসিসির পূর্ব জুরাইন ও ডিএনডিবাঁধ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। তবে যেসব এলাকায় পাম্প ও ড্রেন বসবে বেদখল হওয়া সেসব এলাকায় প্রথমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। এরপর পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হবে। ফলে এলাকার জলাবদ্ধতা কমবে বলে মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে জলাবদ্ধতা বেশি উত্তর সিটিতে। এর মধ্যে কাওরানবাজার, মিরপুর, কালশী, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলক্ষেত এলাকা অন্যতম। কিন্তু দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চেয়ে এ সংস্থাটি অনেকটা স্বাবলম্বী হলেও জলাবদ্ধতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই সংস্থাটির। এখন পর্যন্ত বড়ধরনের দীর্ঘ মেয়াদী কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার অভিযানে নামছি। এরই মধ্যে ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছি। কিছু কিছু খালের মধ্যে বহুতল ভবন পর্যন্ত উঠে গেছে। এ পর্যন্ত অন্তত চার শতাধিক ভবন ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ খালের ওপর চিকন করে পাইপ দিয়ে চলাচলের জন্য পোল নির্মাণ করেছে। এ সপ্তাহে তিনশ’ ফুট এলাকায় আমরা অভিযান করেছি। সম্প্রতি রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে নগরভবনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬৮ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও ৩০০ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন করা হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিট করপোরেশনে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক ‘জেট এ্যান্ড সাকার মেশিন’ যুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা যাবে। কিন্তু, দুই মেয়র, সিটি কর্পোরেশন আর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের এত আশ্বাস ও কর্মসূচীর পরেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। এখনও সামান্য বৃষ্টি হলেই মিরপুর, কালশী, কাওরান বাজার, কুড়িল, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় জমে যাচ্ছে থই থই পানি। মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সালে সংস্থাটিকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করলেও ঢাকা ওয়াসা তার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। ওয়াসার এই ব্যর্থতার দায় যাচ্ছে সিটি করপোরেশনের ওপরে। এ জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে নিতে চায়। এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ড্রেনের দায়িত্ব নিয়ে নিতে চাই, তবে তা ঠিক করে দিতে হবে। জনবল দিতে হবে। আমরা এর রক্ষণাবেক্ষণ করব। আর আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা ওয়াসার ড্রেন নেব। এ নিয়ে শীঘ্রই মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশনের দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা না থাকলেও বিভিন্ন সময় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে যেসব কাজ করা হচ্ছে তা টেকসই নয়। এমন অভিমত নগর পরিকল্পনাবিদদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘যে পদ্ধতিতে দুই সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা এগোচ্ছে তাতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামী বছরগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তার মতে, পানি নিষ্কাশনের দুটি পথ রয়েছে। প্রথমত ভূ-গর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং অন্যটি খাল বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া। রাজধানী ঢাকায় এই দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই। যে কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছে।
×