ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লবণে নির্ধারিত পরিমাণ আয়োডিন থাকতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২ জুলাই ২০১৭

লবণে নির্ধারিত পরিমাণ আয়োডিন থাকতে হবে

তপন বিশ্বাস ॥ এখন থেকে নিবন্ধন ছাড়া কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন প্রকার লবণ আমদানি, গুদামজাত, ভোক্তাপর্যায়ে পাইকারি সরবরাহ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিশোধন, বা আয়োডিনযুক্তকরণ কারখানা পরিচালনা করতে পারবে না। আইনে প্রদর্শিত পরিমাণ অনুযায়ী লবণে আয়োডিন যুক্ত করতে হবে। নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্যাকেটজাত করেই কেবল তা বাজারে দেয়া যাবে। বিধিমালা লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদ- এবং ২৫ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রেখে আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। শিল্প মন্ত্রণালয় আইনটি সংশোধনের খসড়া তৈরি করেছে। খুব শীঘ্র এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে সরকার কঠোর অবস্থানে। খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি ভেজাল লবণ প্রতিরোধে সরকার এই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। বাজারে অনেক কোম্পানির লবণ রয়েছে। এর মধ্যে অনেকে আয়োডিনবিহীন লবণ আয়োডিনযুক্ত বলে চটকদারি বিজ্ঞাপন দিয়ে তা বাজারজাত করছে। এ জাতীয় প্রতারণা প্রতিরোধও এই আইনটি সংশোধনের অপর একটি লক্ষ্য। মূলত ভোজ্য লবণে আয়োডিনযুক্তকরণ, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য তৈরিতে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ ও নিরামনের লক্ষ্যে সরকার আইন সংশোধন করছে। যা সর্বজনীন আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন ২০১৭ নামে অভিহিত হবে। ১২টি অধ্যায়ে ইতিমধ্যে সংশোধিত আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আইনের অধীনে নিবন্ধন না করে কোন ব্যক্তি কোন প্রকার লবণ আমদানি, গুদামজাত, ভোক্তাপর্যায়ে পাইকারি সরবরাহ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিশোধন, বা আয়োডিনযুক্তকরণ কারখানা পরিচালনা করলে ৫ বছরের কারাদ- অথবা ২০ লাখ টাকা অর্থদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত হবেন। আয়োডিনযুক্ত না করার ফলে অন্যের জীবন বিপন্ন হলে ৭ বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকার অর্থদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। এছাড়াও বিভিন্ন অপরাধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে আইনটিতে। খসড়ায় বলা হয়েছে, আয়োডিনযুক্ত লবণ বলতে নির্ধারিত মাত্রায় আহার্য এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার্য আয়োডিনযুক্ত লবণকে বোঝানো হয়েছে। কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত লবণ কারখানা ও শিল্প লবণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়োডিনের অভাবজনিত রোগের বিদ্যমান অবস্থা জাতীয় জীবনে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণের পরিমাপ, লবণ উৎপাদন, পরিশোধন, সরবরাহসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়সমূহ পর্যবেক্ষণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ সেল গঠন করবে। এ সেল থেকে আইনের উদ্দেশ্য পূরণে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এ আইনের অধীনে জাতীয়, জেলা ও প্রান্তিক কমিটি নামে তিনটি কমিটি লবণে আয়োডিনযুক্তকরণের বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করবে। জাতীয় লবণ কমিটি লবণ আয়োডিনযুক্তকরণে আন্তর্জাতিক মান এবং জাতীয় স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা নির্ধারণ করবে। মানুষ অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে কমপক্ষে ৯৬ দশমিক ৯৯ ভাগ সোডিয়াম ক্লোরাইড, অনধিক শূন্য পয়েন্ট ১ ভাগ পানিতে অদ্রবনীয় পদার্থ, কমপক্ষে ৩ দশমিক শূন্যভাগ পানিতে দ্রবণীয় পদার্থ, উৎপাদন পর্যায়ে ৩০ থেকে ৫০ পিপিএম এবং খুচরা পর্যায়ে ২০ থেকে ৫০ ভাগ পিপিএম মাত্রার আয়োডিন, এবং জলীয় অংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৬ দশমিক শূন্য শতাংশ থাকবে হবে। লবণ উৎপাদনকারী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি লবণ কারখানায় প্রেরণের জন্য জাতীয়, জেলা ও প্রান্তিক লবণ কমিটি কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন। ওই লবণ বিজ্ঞানভিত্তিক সংরক্ষণ করা হবে। অপরিশোধিত লবণ এমনভাবে পরিশোধন করতে হবে যেন তার মৌলিক বৈশিষ্ট অক্ষুণœ থাকে। পরিশোধিত লবণে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কিছুই থাকবে না। জাতীয় লবণ কমিটির সুপারিশে লবণ পরিশোধনাগার ও আয়োডিনযুক্তকারী কারখানার জন্য আয়োডিন সরবরাহ করবে। সেই ক্ষেত্রে সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবে। এ আইনের অধীনে সরকার লবণ আমদানির একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। লবণ মৌসুমে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত লবণ দেশের বাৎসরিক চাহিদার কম উৎপাদন হলে কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রে ভোজ্যলবণ উৎপাদন এবং চামড়া শিল্প বা রাসায়নিক কারখানার ব্যবহারের জন্য শিল্প লবণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে অপরিশোধিত লবণ আমদানি করা যাবে। এই আইনের অধীনে নিবন্ধন ছাড়া কেউ লবণ আমদানি করতে পারবে না। কুঠির শিল্প কর্পোরেশন লবণ উৎপাদনের নবকৌশল ও নিরাপদ উৎপাদন পন্থা উদ্ভাবন করবে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেবে। চাষীরা লবণ চাষের কাজে নিয়োজিত থাকার ফলে আক্রান্ত রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। লবণ চাষীদের এক বা একাধিক সংগঠন থাকবে। মৌসুমের পর লবণ শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের কথাও বলা হয়েছে এ আইনে। স্বচ্ছ এবং ফুডগ্রেড প্যাকেটে ভোজ্য লবণ বাজারজাতকরণে ২ মাস সময় প্রদান করা যাবে। ভোজ্য লবণের প্যাকেট ২৫০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম ১০০০ গ্রাম এবং ২০০০ গ্রাম হবে। টেবিল সল্ট হিসেবে ৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম, ২৫০ গ্রামের শক্ত মোড়কে বাজারজাত করা যাবে। লবণ কমিটির পরামর্শে লবণের দাম নির্ধারণ করা হবে। শিল্প লবণের প্যাকেট হলুদ রঙের হবে। প্যাকেটের আকার ও পরিমাপ বিধিতে নির্ধারিত হবে। লবণের সব ধরনের কার্যক্রমের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। নিবন্ধনের মেয়াদ হবে ২ বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩০ দিন আগে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে নির্ধারিত ফরমে নবায়নের জন্য আবেদন করতে হবে। বিধি না হওয়া পর্যন্ত সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন মূলে নিবন্ধন ফি নিবন্ধনের শর্ত এবং নবায়ন ফির হার নির্ধারণ করবে। বিধি না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন প্রচলিত বিধি মোতাবেক নিবন্ধন প্রদান করা হবে। চাষীদের কাছ থেকে অপরিশোধিত লবণ ক্রয় এবং পরিশোধন ও আয়োডিমুক্তকরণ বিক্রয় বিতরণ মজুদ, সরবরাহ ইত্যাদি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবে। যা পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণের সময় দেখাতে হবে। তথ্যাদি রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা না হলে বা ভুল লিপিবদ্ধ করা হলে উক্ত কারখানার বিরুদ্ধে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পরিমাণে জরিমানা আরোপ করা যাবে। সরকারীভাবে নিযুক্ত যে কোন ব্যক্তি লবণ সংক্রান্ত সকল তথ্য দেখতে পারবেন এবং কারখানা মালিকরা দেখাতে বাধ্য থাকবেন। সরকার একটি লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে পারবে। ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম শুরুর আগ পর্যন্ত সরকার যে কোন গবেষণাগারকে লবণ গবেষণাগার হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ এবং তদানুযায়ী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে সরকারের সহায়তায় লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশব্যাপী জরিপ কাজ পরিচালনা করতে পারবে। সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি লবণ পরিশোধন আয়োডিনযুক্তকরণ কারখানা ও গুদামে প্রবেশ পরিদর্শন এবং বিনা নোটিসে তল্লাশি করতে পারবে। সব কাগজপত্র নথি পরীক্ষা করতে পারবে। ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও প্যাকেটে লবণের পরিমাণ পরীক্ষা করতে পারবে। আইনবহির্ভূত যে কোন যন্ত্রপাতির ব্যবহার পরিলক্ষিত হলে তা বাজেয়াফত করতে পারবে। আইনে নির্ধারিত গুণগতমান নিশ্চিত না করে কেউ লবণ উৎপাদন করতে পারবে না। করলে ৫ বছরের কারাদ- ২০ লাখ টাকার অর্থদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। ভোজ্য লবণে আয়োডিনযুক্ত না করলে ৫ বছরের কারাদ- ২০ লাখ টাকার অর্থদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। মুদি দোকানি ও খুচরা বিক্রেতা এর আওতায় পড়বেন না। প্যাকেট বা লেবেল ছাড়া ভোজ্য লবণ বিক্রি, প্রদর্শন, গুদামজাত, সরবরাহ বিতরণ করা যাবে না। করলে ৫ বছরের কারাদ- ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। একই বিধান অভোজ্য লবণের ক্ষেত্রেও রাখা হয়েছে। প্যাকেটের ওপর পণ্যের ওজন পরিমাণ উৎপাদন ও ব্যবহার বিধি ব্যাচ, নম্বর, সর্বোচ্চ খচরামূল্য উৎপাদনের তারিখ প্যাকেটজাতকরণের তারিখ এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করলে ২ বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা অথবা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। আয়োডিনযুক্ত না করার ফলে অন্যের জীবন বিপন্ন হলে ৭ বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকার অর্থদ- অথবা উভয়দ-ে দ-িত করা হবে। দ-ের অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারকে প্রদান করা হবে।
×