ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তবু চরের মানুষ চরেই থাকে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১ জুলাই ২০১৭

তবু চরের মানুষ চরেই থাকে

বর্ষায় চরের মানুষের জীবনযাত্রা কেমন? এ প্রশ্নœ হতে পারে সমতল ভূমিতে বসবাসকারী মানুষজনের। চারদিকে যখন থৈ থৈ পানি, তখন চরের মানুষ কোথায় থাকে, কিভাবে বেঁচে থাকে? এতাসব প্রশ্নের জবাব সহজ নয়। প্রকৃতপক্ষে বর্ষায় চরের মানুষের জীবনে নেমে আসে মহাদুর্যোগ। ইতিহাসের দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহতম বন্যা ১৯৮৮ সাল। এরপর বড় বন্যা হিসেবে ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালের বন্যায় চর এবং সমতল ভূমিতে বসবাসকারী মানুষ বানের পানিতে একাকার হলেও চরের জীবন ছিল ভিন্নতর। নৌকা ও ঘরের চালার ওপর তারা বসবাস করেছে। ঘুমিয়েছে খোলা আকাশের নিচে। ঘরের তৈজসপত্র বেশিরভাগ মানুষের ডুবে গেছে। হাঁসমুরগি গবাদীপশু বানের পানিতে ভেসে গেছে, মরে গেছে। তারা শুধু মাঝে মধ্যে দু’চারদিন শুকনো খাবার খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকার শব্দ শুনলেই তারা বুভুক্ষু মানুষের মতো তাকিয়ে ডাকাডাকি করেছে সাহায্যের জন্য। স্বাভাবিক বন্যা হলেও চরের অধিকাংশ বাড়িঘর ডুবে যায়। মানুষের কষ্ট বাড়ে। সীমাহীন কষ্টের মধ্যেও চরের মানুষ চরেই থাকে। প্রমত্তা যমুনাপারের সিরাজগঞ্জের পাঁচ উপজেলায় প্রায় ২৫ ইউনিয়নবাসী বসবাস করে দুর্গম চরে। এর মধ্যে চৌহালী উপজেলার সাত ইউনিয়ন, কাজীপুর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন, বেলকুচি উপজেলার তিন ইউনিয়ন শাহজাদপুরের তিন ইউনিয়ন পুরোটাই যমুনার দূর্গম চরে অবস্থিত। নানা দুর্যোগে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে চরের মানুষ। অতি বন্যা, ভাঙন আর রোদের খরতাপে চরের মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। তবে চরের মানুষ কখনও পিছপা হয় না। চর ছেড়ে সমতলভূমিতে আসতে চায় না। পরিস্থিতি মানিয়ে তারা চরেই জীবন নির্বাহ করে। ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চরের মানুষের পেশাও বদল হয়। বর্ষায় তারা নৌকার মাঝি, শুকনো মৌসুমে কৃষক। কখনও জেলে আবার কখনও ঘাটের কুলি। অভাব অনটন আর শত সহস্র সমস্যা বুকে আগলে ধরে চরের মানুষ পড়ে থাকে চরে। সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে যমুনার বালিয়াড়িতে তৈরি ছনের ঘরেই পরম সুখে ঘুমায়। স্থায়ী সমতল ভূমি চরের মানুষকে আকর্ষণ করে না। চর তাদের আসল ঠিকানা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যমুনাসহ নদ-নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়। তবে গত পাঁচ বছরে চরের জীবনযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। অনেকেই টিনের ঘরে বসবাস করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও পাকা হয়েছে। সোলার বিদ্যুত ব্যবহার করে। ঘরে রয়েছে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন। প্রমত্তা যমুনাও আর আগের মতো নেই। নদী দেখে মনে হয় না, এখানে একদিন প্রবল স্রোতস্বিনী উত্তাল নদী ছিল। যমুনা এখন বিগত যৌবনা। নদীর পাড় আর চরে বাস করে অর্ধলক্ষ মানুষ। এরা প্রতিনিয়ত বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে। লড়াই করছে নদীর নিষ্ঠুর ভাঙ্গনের সঙ্গে। বিশাল যমুনাচরসহ নদী পাড়ে বসত করা এসব মানুষ নদীর গতি প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেঁচে থাকে। অভাব অনটন ক্ষুধার যন্ত্রণা থাকলেও চরের মানুষ চর ছাড়তে চায় না। নদীর টানেই চরের মানুষ আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকে ভাঙ্গা জীর্র্ণ কাশের ঘরে। বুক ভরা আশা, যে নদী দিনের পর দিন তাদের সর্বস্ব গ্রাস করেছে সে নদীই একদিন ফিরিয়ে দেবে বাপ-দাদার জমি জিরাত। বুক ভরা আশা, যদি হারিয়ে যাওয়া জোত জমি আবার জেগে ওঠে। এই আশা নিয়ে নদী আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করছে চরের মানুষ। শত দুঃখ যন্ত্রণা আর অভাব অনটন নিয়ে চরের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, ভাঙ্গা গড়াই নদীর খেলা। নদী পারের মানুষ আর চরবাসী মনে করে, জোত জমি গেছে, গেছে ঘরবাড়ি ভিটেমাটি তাতে দুঃখ নেই। রাক্ষুসী যমুনা সব কেড়ে নিয়েছে। নদীর সঙ্গেই তারা যুদ্ধ করছে। নদীতেই তারা মরণ চায়। তাদের প্রত্যাশা তবুও নদী বেঁচে থাক। আগের মতো উত্তাল হয়ে উঠুক। বর্ষাকালে উত্তাল নদীর স্রোতধারার সঙ্গে নদীবক্ষে বয়ে আনবে উর্বর পলি। শুকনো মৌসুমে জেগে ওঠা সেই নরম পলিতে ফলাবে ফসল। বর্ষাকালে উত্তাল নদীতে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে মাছ ধরে। আবার একদিন ছিল, যেদিন তারা ঘাটের কুলি মজুরের কাজ করে জীবন কাটিয়েছে। বিশাল যমুনার এক সময় স্রোতধারা হারিয়ে যায়। জেগে ওঠে বিশাল বিস্তীর্ণ চর। এই চরে এসে মানুষ বসতি গড়ে তোলে। জেগে ওঠা এসব চরের বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। এসব দুর্গম চরের মানুষ ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পেশা পরিবর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করে। _বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে
×