ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাঙ্গা গড়ার মধ্যেই জীবনের জয়গান

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১ জুলাই ২০১৭

ভাঙ্গা গড়ার মধ্যেই জীবনের জয়গান

চরাঞ্চল বা ‘চর’ শব্দটি এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুর্গম আর অবহেলিত জনপদের কথা। খড়ের চালার খুপরি ঘর, আলোহীন, স্বাস্থ্যহীন, শিক্ষাহীন, নাগরিক সেবা বঞ্চিত অজানা জনপদ। যেখানে কৃষিকে পুঁজি করে চলে সংগ্রামী মানুষের জীবনগাথা। ভাঙা-গড়ার মধ্যে টিকে থাকার জীবন সংগ্রাম যেখানে নিত্য কাহিনী। বর্ষা এলে সেখানে গিলে খায় বসতি, আবার শুষ্ক মৌসুমে জমে ওঠে নতুন ঘর তোলার প্রতিযোগিতা। বছরের পর বছর ঘর-বসতি হারিয়ে নিঃস্ব হলেও চরের মায়ায় জীবন যাদের জড়িয়ে থাকে অন্ধকারে আলোক বর্তিকা হয়ে। তাই বার বার চরেই গড়ে ওঠে তাদের জীবনের নতুন জয়গান। রাজশাহী শহরের দক্ষিণে প্রমত্তা পদ্মা। এ নদী পেরিয়ে বিশাল ভূখ- এখানকার চরাঞ্চল। শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা পদ্মার চর। নগরীর অদূরে গড়ে ওঠা চর প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বিলীন হয়, আবার গড়ে ওঠে শুষ্ক মৌসুমে। যেন ভাঙ্গা-গড়ার প্রতিযোগিতা চলে পুরো চরাঞ্চলে। পদ্মা নদী কেন্দ্রিক পবা, গোদাগাড়ী, চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় রয়েছে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। গোদাগাড়ীর চরআষাঢ়িয়াদহ, পবার চরখানপুর, চরখিদিরপুর, বাঘার চরতারানগর, চররাজাপুর ইউনিয়নের অবস্থান ভারতীয় সীমান্ত এলাকায়। এসব চরে সব মিলিয়ে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এদের জীবন সংগ্রামী। শুষ্ক মৌসুমে চরের উর্বর ফসলি জমিই তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। কোনভাবে শুষ্ক মৌসুম পাড়ি দিলেও বর্ষা এলে তাদের আশ্রয় খুঁজতে হয় অন্যত্র। সাময়িক সময়ের জন্য অন্যত্র আশ্রয় নিলেও বর্ষার পর আবার শুরু হয় নতুন বসতি গড়ার সংগ্রাম। যুগ যুগ ধরে এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে জীবন বাজি রেখে চলে চরবাসীর জীবন। ছিন্নমূল কিংবা একা হয়ে পড়া নাগরিকদের বিশাল অংশের বাস এসব চরাঞ্চলে। পবা উপজেলার পদ্মার চরখানপুরের বাসিন্দারা জানায়, বাপ-দাদার আমল থেকেই তাদের বসবাস। এক সময় চরেই ছিল তাদের ফসলি জমি। ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু। চরের জমির ধান দিয়েই সংসার চলত সারা বছর। প্রতি বর্ষায় ভাঙনের কবলে পড়ে বলতে গেলে এখন সবাই নিঃস্ব। বর্ষার পর আবার জেগে ওঠা চরের জমিই হয় তাদের সম্বল। বর্ষা শেষে জেগে ওঠা চরে আবার বসতি গড়ে শুরু হয় সংগ্রাম। এ যেন ভাঙন বনাম জীবনের খেলা। পবার চর খানপুরের ষাটোর্ধ লোকমান হাকিম বলেন, বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বাড়লে ও বন্যার আভাস পেলে পরিবার নিয়ে আশ্রয় গাড়েন অন্যত্র। আবার শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে উঠলে ফিরে আসেন। এভাবে বছরের পর বছর তাদের ঘর বদলাতে হয়। তারপরেও টিকে থাকেন। কারণ এখনকার চর একসময় বাপ-দাদার ভিটা ছিল। লোকমান হাকিম বলেন, সব মিলিয়ে গত ২৫ বছরে তিনি ঘর হারিয়েছেন কমপক্ষে ১৫ বার। গত বারের ভাঙনে শেষ সম্বল নিজের ভিটাটুকুও বিলীন হয়। তারপরও চরের মায়া দূরে থাকতে দেয় না। শুষ্ক মৌসুম এলেই সেখানেই ফের বাসা বাঁধেন। বসবাস করেন। চরই যেন তাদের শেষ ভরসা। হারানো ভিটামাটির নামমাত্র চিহ্ন ছেড়ে কোথাও যেতে মন চায় না। একই চরের আজগার আলী জানান, চর পার হয়ে কিছু দূরেই রাজশাহী শহর। বর্ষায় সেখানে অনেকেই আশ্রয় খোঁজে, নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে। পানি নেমে চর জাগলে চরের মায়ায় আবার ফিরে আসেন। কারণ তাদের জীবন দুর্গম পদ্মার চরেই বাঁধা। চরখিদিরপুরের হযরত আলী। তিনিও বাপ-দাদার আমল থেকে এই চরেই বসবাস করছেন। পদ্মা তাঁর বাড়ি খেয়েছে অন্তত ১০ বার। কখনও কখনও সংসারের জিনিসপত্রও সামলাতে পারেননি। সব পানির তোড়ে ভেসে গেছে। দুর্গম এলাকার বাসিন্দা বলে ছয় ছেলেমেয়েকে না পেরেছেন লেখাপড়া করাতে, না পেরেছেন কর্মজীবী করে গড়ে তুলতে। চরখিদিরপুর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে শহরে গিয়ে বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাতে পারতেন। কিন্তু বাপ-দাদার ভিটা যা এখন পদ্মার চর তা ছেড়ে যেতে চান না হযরত আলী। _মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×