ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নদীর এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১ জুলাই ২০১৭

নদীর এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা

চিরন্তন সেই সুর ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা/সকাল বেলার আমীর রে ভাই, ফকির সন্ধ্যা বেলায়...’ নদী ভাঙন আর চর জেগে ওঠার এই খেলা নিরন্তর। ষাটের দশকের শুরুতে এই দেশের বর্ষীয়ান এক নেতা বলেছিলেন ‘বান তুফান আইলে ঘর বাড়ি জিনিসপত্তর কিছু পাওয়া যায়। আগুনে পুড়লে ভিটির ছাই পাওয়া যায়। নদীর ভাঙনে কিছুই পাওয়া যায় না সব ভাইস্যা নিয়া যায়...।’ তখনই নদী সিকস্তি আর পয়স্তি এই শব্দগুলো আসে। নদী ভাঙনে যারা সর্বস্বান্ত হয় তারা নদী সিকস্তি। আর নতুন করে চর জাগলে আবাদযোগ্য জমিতে যারা চাষাবাদ করে তারাই নদী পয়স্তি। নদী যখন জমি ঘরবাড়ি বসতভিটা গ্রাস করে গর্ভে নিয়ে যায় তখন কোন দাবিদার থাকে না। নদী যখন সেই জমি চর সৃষ্টি করে ফিরিয়ে দেয় তখন দাবিদার তৈরি হয়। যাদের বেশিরভাগই নকল দাবিদার। তখনই বেধে যায় সংঘাত। এই চর নিয়ে অনেক কথা। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র মেঘনা- মূল এই তিন নদী ও তার শাখা প্রশাখা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সাগরে মিশেছে। নদী প্রবাহের ৮০ শতাংশ ঘটে বর্ষা মৌসুমে, (জুন-সেপ্টেম্বর) বহন করে প্রায় তিন মিলিয়ন টন পলি। পলি বহনের নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে। বেশি বহন করতে হলে বন্যার সময় ধারণ করতে না পারলে গতি পরিবর্তনে পাড় ভাঙতে হয়। তারপর কোন এক সময়ে চর জেগে ওঠে। এক সূত্রের মতে দেশে নদী থেকে জেগে ওঠা চর-২ হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি। সবচেয়ে বেশি চর যমুনায় প্রায় ১১শ’ বর্গ কিলোমিটার। বাকি চর গঙ্গা পদ্মা উত্তর ও দক্ষিণ মেঘনা অববাহিকায়। চরের পলিমাটির ওপর আবাদ করেই জীবন নির্বাহ করে চরের মানুষ। বিচিত্র জীবন তাদের। বগুড়ায় যমুনা তীরের সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটি যমুনার চরে। ধুনট উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন চরের মধ্যে। বংশ পরম্পরায় লোকজন সেখানে বাস করলেও একটা সময় এই চর ছিল নদীগর্ভে। চর সৃষ্টি হওয়ার যারা প্রথমে গিয়ে সেখানে বসতি গড়েছে তারা সেই জমির মালিকানা দাবি করে। আবার চর জেগে ওঠার সময় লাঠিয়াল নিয়ে যে প্রভাবশালীরা চর দখল করে তারাও শক্তির বলে চরের দাবিদার সাজে। এভাবে দেখা যায় চরের বেশিরভাগ মানুষ উদ্বাস্তু। শুকনো মৌসুম নদী পথ রুদ্ধ করে দেয় চর। বগুড়ায় যমুনায় পড়েছে অসংখ্য চর। ডুবোচর পড়েছে কয়েকটি পয়েন্টে। নদী পথের খেয়া পারাপার প্রায় বন্ধ। যমুনা তীরের সারিয়াকান্দির কালিতলা মূল খেয়াঘাট থেকে স্থানীয় ১৪টি রুট ও আঞ্চলিক তিনটি মোট ১৭টি রুটে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। খেয়াঘাটকে কেন্দ্র করে যে ব্যবসা গড়ে ওঠে তার বেশিরভাগই বন্ধ। কেন এত চর পড়ছে তার কারণ হিসেবে বলা হয় নদীর নাব্য কমে সর্বনি¤œ পর্যায়ে চলে গেছে। বানের ঢলে পলি পড়ে নাব্যকে আরও খানিকটা কমে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে যমুনায় চর পড়েছে অন্তত ১৫শ’ বর্গ কিলোমিটার। গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে যমুনার চর দৃশ্যমান। সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটি যমুনার চর। এইসব চরে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। স্থানীয়রা জানালেন কাজলা, বোহাইল, চন্দনবাইশা, কর্নিবাড়ি, চালুয়াবাড়ি, কামালপুর হাটশেরপুরে চর পড়েছে বেশি। অন্তত ৬২টি চর পড়েছে এই সাত ইউনিয়নের গ্রামে। এই চর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বগুড়া ছাড়াও সিরাজগঞ্জ গাইবান্ধা জামালপুরের লোকজন নৌকায় চলাচল করে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় খেয়া পারাপার বন্ধ। মাঝিমাল্লারা অলস সময় কাটাচ্ছে। যেসব ঘাট দিয়ে প্রতিদিন তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ নৌকা চলাচল করত সেখানে হাতে গোনা কয়েকটি এক চর থেকে আরেক চরে ট্রানজিট করে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। সারিয়াকান্দির সঙ্গে পাকুল্লা, সোনাতলা, ধুনট, চন্দনবাশি, কাজরা, চর বোহাইল, বেনিপুর, মানিকদাইর, চালুয়াবাড়ি, হাসনারপাড়া, দিঘাপাড়া, কামালপুর, কর্নিবাড়ি, নয়াপাড়া, মথুরাপাড়া, আওলাকান্দি, জামালপুরের মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, তারাকান্দি (যমুনা সার কারখানা) গাইবান্ধার ফুলছড়ি, বালাসী, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর রুটে নৌ চলাচল বন্ধ। এইসব চরের খেয়াঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ব্যবসা বানিজ্য। কালিতলা গ্রোয়েনের কাছে এক দোকানী বললেন ‘ব্যবসা লাটে উঠিছে। মানষই (মানুষ) আসে না। বেচাকেনা হবি কুন্টি (কোথায়) থাক্যে।’ _সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×