ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমলিন দুর্গতি

বর্ষায় চরজীবন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১ জুলাই ২০১৭

বর্ষায় চরজীবন

বর্ষা মানে চরের মানুষের অন্য রকমের জীবন। একেবারে ভিন্নধারা। বছরের বাকি সময়টার সঙ্গে কোনমতে মেলে না বর্ষার ছবি। এ সময়টা কেবল টিকে থাকা। রুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই। আকাশ থেকে নেমে আসা পানি কিংবা নদী-সাগরের উতলা পানির সঙ্গে সমানে লড়াই চরের মানুষের নিয়তি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ চিত্র আজও পাল্টায়নি। অমলিন দুর্গতির ছবি। দেশের দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর সঙ্গে দেশের অন্যান্য প্রান্তের চরাঞ্চলের ভূ-গঠন কিংবা ভূপ্রকৃতিতে যেমন অনেক ক্ষেত্রে মিল রয়েছে, তেমনি বেশ কিছুটা প্রভেদও রয়েছে। পটুয়াখালীর দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বঙ্গোপসাগরের যত্রতত্র মাথা ফুঁড়ে পটুয়াখালীর সীমানায় যেমন অসংখ্য দ্বীপ জেগে উঠেছে। আবার নদ-নদীর কূল ঘেঁষে রয়েছে অজস্র্র চর। এসব দ্বীপের চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে সাগরের নোনা পানি। আর চর দাঁড়িয়ে আছে নদীর তীর ঘেঁষে। পটুয়াখালী জেলায় ঠিক কতটা চর ও দ্বীপ রয়েছে এবং এগুলোর আয়তন সম্পর্কিত সঠিক পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট দফতরেও নেই। অনেক ক্ষেত্রেই আন্দাজের ওপর ভর করে চলে কাজকর্ম। বিভিন্ন সময় চর ও দ্বীপ ঘুরে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে- কেবল বসতি রয়েছে, পটুয়াখালীতে এমন চর-দ্বীপের সংখ্যা এক শ’য়ের বেশি। মানুষের বসতি নেই, এমন চরের সংখ্যাও কম নয়। মানুষের বসত রয়েছে, এমন চর-দ্বীপে কিছু সমস্যা রয়েছে, যা অভিন্ন। আবার এক চর-দ্বীপ থেকে আরেক চর-দ্বীপের ভিন্ন সমস্যাও রয়েছে। যেমন যেসব দ্বীপ-চরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে, তাদের সমস্যার সঙ্গে বেড়িবাঁধ নেই চরাঞ্চলের সমস্যার ভিন্নতা রয়েছে। বেড়িবাঁধের কারণে চর-দ্বীপের মানুষ ঝড়-বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের ছোবল থেকে রক্ষা পায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অনেকটা রেহাই মেলে। কিন্তু যেসব চর-দ্বীপে বেড়িবাঁধ নেই, তারা বর্ষার পুরো সময়টা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পার করে। চরআগুনমুখা, চরকারফারমা, বুড়িরচর, চরলতা, মাঝেরচর, চরকাশেম, চরনজির, চরতুফানিয়া, ডিগ্রীরচর, চরআমখোলা, চরমায়া, চরকলাগাছিয়াসহ বেড়িবাঁধ নেই এমন বেশ কয়েকটি চর-দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, এসব চর-দ্বীপের মানুষ বর্ষায় চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। বর্ষা মানে একদিকে চরের মানুষের কাছে নতুন প্রাণের স্পন্দন। বর্ষা শুরু হলে নতুন ঘাষ জন্মায়। যা গৃহপালিত গবাদিপশুকে শক্ত-সমর্থ হতে সহায়তা করে। বর্ষায় মাটি নরম হয়। যা রোপা আমন চাষে সহায়ক হয়। নৌনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়। বর্ষার উজানে ধেয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে দেশী মাছ। যা কৃষকের বাড়তি আয়ের পথ খুলে দেয়। এমন নানা সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি বর্ষা চর-দ্বীপের মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। সরেজমিন দেখা গেছে, বর্ষার পানিতে সাগর-নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠে। দিনে-রাতে সাগর-নদীতে দুই বার জোয়ার-ভাটা আসে। জোয়ারে কানায় কানায় পূর্ণ হয় নদী। বেড়িবাঁধ নেই এমন চর-দ্বীপ সেই জোয়ারের পানিতে পুরোপুরি প্লাবিত হয়। ভেসে যায় ঘরবাড়ি, গাছপালা, গৃহপালিত গবাদিপশু থেকে শুরু করে সবকিছু। চর-দ্বীপের বেশিরভাগ বসতঘর মাটির ভিটির ও বাঁশের বেড়ায় তৈরি। জোয়ারের স্র্রোতে ভেঙ্গে পড়ে কৃষকের সাজানো সংসার। নিশ্চিহ্ন হয় মাটির চুলা। ভেসে যায় হাঁড়ি-পাতিল, বাক্সপেটরা, কাঁথা-বালিশ, পোশাক। বহু চরের মানুষ জোয়ার আসার আগেই উঠে পড়ে নৌকা কিংবা কলাগাছের ভেলায়। অনেকে ওঠে উঁচু মাচায়। সঙ্গে নিয়ে সাংসারিক সরঞ্জাম। কেউ কেউ ওঠে উঁচু গাছের মগডালে। যারা উঠতে পারে না। তাদের স্বপ্নের সংসার হাবুডুবু খায় জোয়ারের পানিতে। ঘরের উঁচু মাচায় উঠেও অনেকে ভোগান্তির হাত থেকে রেহাই পায় না। বাড়ির আশপাশে ও বসতঘরের ভিটায় পানির বুকে কিলবিল করে সাপ-জোঁক, বিষাক্ত পোকামাকড়। প্রতিবছর কত মানুষ বিশেষ করে শিশুদের এভাবে প্রাণ যায় সাপ কিংবা পোকামাকড়ের কামড়ে, তারও নেই কোনো হিসেব। প্রতি মাসে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময়ে জোয়ারের উগ্রতা বাড়ে। জোয়ের হাত ধরে আসে জোয়ার-ভাটা। দিন-রাতে অন্তত ১০-১২ ঘণ্টা স্থায়ী হয় জোয়ার। এভাবে চলে ১০-১৫ দিন। এ সময়টা চরবাসীর জন্য মহাদুর্ভোগের কাল। খড়ের ছাউনি দেয়া বসতঘরের চাল চরবাসীর জন্য বর্ষার আরেক ভোগান্তি। বর্ষায় খড়ের চাল পচে যায়। আকাশ থেকে নামে অঝোর বর্ষণ। সে বর্ষণে জীবন হয় ওষ্ঠাগত। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চরের মানুষকে কাটাতে হয় নিদ্রাহীন। বর্ষায় আয়-উপার্জন হয়ে পড়ে সীমিত। যা জীবন ধারণকে করে কষ্টকর। ঘরে ঘরে দেখা দেয় অভাব। একমুঠো চালের জন্য চলে আহাজারি। দেখা দেয় রোগ-ব্যাধি। চরে নারী-শিশুর জীবন এমনিতেই সংগ্রামমুখর এবং চরম প্রতিকূল। তার ওপর বর্ষা আরও দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নারীকে সামলাতে হয় সংসার। দেখতে হয় কোলের শিশু সন্তান, গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগি। সবই দেখে শুনে রাখে নারী। প্রকৃতি যতই বৈরী হোক, নারীকে তুলে দিতে হয় পুরুষের পাতে ভাত। নেই চুলা। নেই রান্নার সরঞ্জাম। নেই চাল। তবুও পুরুষকে দিতে হয় সময়ের খাবার। প্রকৃতিকে জয় করার এক আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি নিয়ে লড়াই করতে হয় চরের নারীকে। বহু নারী উত্তাল নদীতে জাল ফেলে মাছও ধরে। আবার জমিতেও সময় জোগায়। অন্য চরের নিকটজনদের সঙ্গে যোগাযোগটাও জিইয়ে রাখে নারী। বর্ষায় চরে উৎপাত বাড়ে হিংস্র প্রাণীর। পটুয়াখালীর প্রতিটি চরেই কম-বেশি বনাঞ্চল রয়েছে। আর সেসব বনাঞ্চল হয়ে উঠেছে হিংস্র্র বণ্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। বর্ষায় রাত হলে বনাঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসে হিংস্র্র প্রাণীর দল। যারা কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে চরবাসীকে। শিশুদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। স্কুলে যেতে ভোগান্তি বাড়ায়। বর্ষা মানে চরের মানুষের এমন কষ্টের নানা উপাখ্যান। কল্পনাতীত দুঃসময়। যা কেবল চরবাসীই জানে এর অন্তর্গত মনযাতনা। তার পরেও চর-দ্বীপে মানুষ বাস করে। জীবন কাটায় নিরুপায়হীন। চরবাসীর একটি অংশের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাই চরে জীবন কাটায়। আরেকটি অংশ জীবন পার করে আশা নিয়ে। কাছের এ নদীটা জমি-জিরেত, ঘর-সংসার সব কেড়ে খেয়েছে, আজ না হোক, কাল একদিন ওই নদী সব ফিরিয়ে দেবে, সে আশায় ঘর বাঁধে চরের ভাঙ্গন কূলে। সে আশায় গোনে দিন। জীবন কাটে কষ্টে। তবু দেয় না কোথাও পাড়ি। বর্ষা হোক না দুর্ভোগের কাল। তারপরেও চরের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। এ এক অন্য জীবন। _শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×