ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঔষধি ফল

দেখা মাত্র জিহ্বায় জল আসে, কমছে তেঁতুল বৃক্ষ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১ জুলাই ২০১৭

দেখা মাত্র জিহ্বায় জল আসে, কমছে তেঁতুল বৃক্ষ

সমুদ্র হক ॥ তেঁতুল। আরেক নাম তিন্তিড়ী। এই বৃক্ষ দেখার চেয়ে তেঁতুল দেখা বেশ মজার। বিশ্বে তেঁতুল একমাত্র ফল দেখার সঙ্গেই জিহ্বায় সেলভিয়া (লালা) বেড়ে যায়। কেউ চুকচুক শব্দে আহ্-উহ্ করতে থাকে। একটা সময় তেঁতুল বৃক্ষ গ্রামের কোন বাড়ির দিক নির্দেশক ছিল। তেঁতুল গাছ নিয়ে আছে অনেক কল্পকথার মজার গল্প। বিশেষ করে তেঁতুল গাছের ভূত (ভূত বলে কিছু নেই)। নানি দাদিরা তেঁতুল গাছের কথিত ভূত নিয়ে কিই না মজা করতেন। এর প্রভাবও পড়ত। রাতে তেঁতুল তলা দিয়ে সহজে কেউ হাঁটত না। তেঁতুল নিয়ে যে কত কথা! গ্রামে কোন নবপরিণীতা এক বছর পর তেঁতুল খেলে গাঁয়ের নারীদের মধ্যে কানে কানে পৃথিবীতে নতুন অতিথি আগমনের খবর রটে যায়। রোমান্টিকতাও আছে তেঁতুলকে নিয়ে। বিজ্ঞান বলছে, তেঁতুলের অত্যধিক দ্রব্য ও ঔষধি গুণাগুণের জন্য প্রকৃতি মানুষের মধ্যে তেঁতুল আকর্ষণের ক্ষমতা দিয়েছে। বাদামী রঙের একেকটি পাতলা খোসার মধ্যে ৬ থেকে ১২ টি চেম্বারে থাকে চকলেট রঙের এই ফল। বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসে আশ্বিনী তেঁতুলের হলদেটে ফুল ফুটে কেবল ফল (তেঁতুল) বের হতে শুরু করে। ঝুলে থাকে গাছের শাখায়। তবে জানুয়ারি থেকে মার্চেই ফলন বেশি হয়। তেঁতুল টক। এই ধারণা এখন ভুল। মিষ্টি তেঁতুলও ফলে এই দেশে। বৃক্ষ দেখতে একই। তেঁতুল মিষ্টিই হোক আর টকই হোক মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ চিরন্তন। মিষ্টি তেঁতুলের স্বাদ অনেকটা আম্রপালি আমের মতো। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তেঁতুলকে নিয়ে হালে নানা ধরনের গবেষণা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করেই বলছেন, একমাত্র তেঁতুলেই আছে সবচেয়ে বেশি এ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা মানব দেহের জন্য অতি প্রয়োজন। সঙ্গে আছে টারটেরিক এসিড, ভিটামিন ডি, কে, সি। যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায়। রসায়নের হিসাবে মিষ্টি তেঁতুলে মিষ্টি মান বা ব্রিক্স ভ্যালু ২৬। টক তেঁতুলেও মিষ্টি মান আছে তার সঙ্গে বাড়তি হিসাবে আছে অনেক গুণ। তেঁতুলের পানি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের রোগীর কোলেস্টেরল কমায়। হিট ও সান স্ট্রোকে,পা জ্বালা পোড়ায়, রক্তক্ষরণ কমাতে, ক্ষুধা মন্দা দূর করতে তেঁতুল দ্রুত কাজ করে। নিমন্ত্রণে রিচ ফুড খাওয়ার পর এক কাপ তেঁতুল পানি শরীরের ফ্যাট কেটে দেয়। অনেক সময় বেশি তেলযুক্ত খাবারে তেঁতুল মেশানো হয়। দ্রব্যগুণে মেটাল পলিশ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় তেঁতুল। তেঁতুলের ঔষধি ও দ্রব্যগুণ বিবেচনায় এনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মেক্সিকোতে বাণিজ্যিকভাবে তেঁতুল গাছের চাষ শুরু হয়েছে। ভারতে বর্তমানে বছরে আড়াই লাখ মেট্রিক টন তেঁতুল উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী ৫ বছরে এই পরিমাণ দশগুণ বাড়াতে তারা প্রস্তুতি নিয়েছে। ট্রপিক্যাল অরিজিনের তেঁতুল গাছের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা। বিজ্ঞান নাম ‘ট্যামারডাস ইন্ডিকা’। সুদান ও মরু অঞ্চল হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছে তেঁতুল। তেঁতুল গাছের সংখ্যায় থাইল্যান্ড এগিয়ে। সে দেশের সেথিহাবুন প্রদেশের জাতীয় গাছ তেঁতুল। রাজধানী ব্যাঙ্কক নগরীতে অতিথি আপ্যায়নে তেঁতুল আবশ্যিক। জাপান, ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া ফিলিপাইন মিয়ানমারেও তেঁতুল রাজকীয় ফলের মর্যাদায় অভিষিক্ত। বাংলাদেশে সামাজিক জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তেঁতুল প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। তেঁতুলের বীজ বের করে হাতের মুঠোয় ভরে মওয়ার মতো করে নগরীতে গ্রামের হাট বাজারে, মেলায় বিক্রি হতে দেখা যায়। বেশিরভাগ গৃহিণী তেঁতুলের আচার বানাতে এক্সপার্ট। কিছুটা পাকা তেঁতুল বইয়ামে ভরে রাখা হয়। এই তেঁতুল এনার্জি এনে দেয়। সব অঞ্চলের মাটিতেই তেঁতুল গাছ জন্মায়। পথের ধারে ছায়া সুশীতল করার পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধক গাছ হিসেবেও তেঁতুল বড় ভূমিকা রাখে। নিকট অতীতে প্রতিটি গ্রামে একাধিক তেঁতুল গাছ দেখা যেত। তেঁতুলের আজ আর সেই দিনও নেই, সেই অবস্থাও নেই। তেঁতুল বৃক্ষ একই পথে। পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকা ও উপকূলীয় এলাকায় মিষ্টি তেঁতুল গাছের দেখা মেলে। সমতল ভূমির উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল ছিল টক তেঁতুল প্রধান এলাকা। এখন টক তেঁতুল গাছের দেখা মেলে না সহজে। দেশে তেঁতুল গাছের সংখ্যা কমে গিয়েছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর কথা- তেঁতুলের বীজ বুনলে বেড়ে উঠতে সময় নেয় ৮ থেকে ১০ বছর। তবে কলম করলে চার বছরেই ফল ধরে। ১৮ থেকে ২০ মিটার (৫৪ থেকে ৬০ ফুট) উঁচু প্রতিটি গাছে সাধারণত বছরে ২শ’ কেজি করে তেঁতুল ফলে। তেঁতুল কাঠের কদর এখন বেড়েছে। আধুনিক আসবাবপত্র তৈরি হচ্ছে তেঁতুল কাঠে। বাংলা সাহিত্যে চলচ্চিত্রে তেঁতুল এসেছে প্রতীকী হয়ে। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান জীবন থেকে নেয়া ছবিতে তেঁতুলের দৃশ্য রেখেছেন। তেঁতুল বাঙালীর জীবনের ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে আছে। বর্তমান প্রজন্ম নানি দাদিদের কাছ থেকে অনেক গল্পের মধ্যে তেঁতুলের গল্প আজও শোনে। ঘরের কোন জায়গায় থাকা তেঁতুল দেখে। তবে সহজে তেঁতুল বৃক্ষ দেখে না।
×