ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিতদের কথা

ঈদ আসে ঈদ যায়, কিন্তু তারা থাকেন নিরানন্দই

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১ জুলাই ২০১৭

ঈদ আসে ঈদ যায়, কিন্তু তারা থাকেন নিরানন্দই

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ঈদ আসে ঈদ যায়; কিন্তু তারা পরিবারের সঙ্গে ঈদে আনন্দ ভাগাভাগি করার সুযোগ পান না। বরাবরের মতো এবারের ঈদেও তারা নতুন কাপড় পরেছেন, খেয়েছেন উন্নত খাবার। তবে অধিকাংশই আত্মীয়-স্বজন বা আদরের সন্তানটির দেখা পাননি। অধীর আগ্রহ নিয়ে ঈদের দিনটিতে প্রহর গুনেছেন, হয়ত কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। কিন্তু দিন শেষেও কারো সাক্ষাত মেলেনি। তবে প্রবীণ নিবাসের অনেকেই ছুটি নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি গেছেন। ঈদের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত হিতৈশী প্রবীণ নিবাস নামক বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের নিবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে এমন কথা জানা গেছে। কথা বলার সময় আপনজনদের কথা স্মরণ করে অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ক্ষোভে-দুঃখে অনেকে স্বজনদের নামও উচ্চারণ করতে চাননি। রাজধানীর হিতৈষী প্রবীণ নিবাসের এক সদস্য মীরা চৌধুরী। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঠিকমতো হাঁটতেও পারেন না। বেশিরভাগ সময় তিনি শুয়ে কাটান। ঈদের দিন কি করলেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, পরিবার নিয়ে ঈদ করার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। দু’বছর ধরে এখানেই ঈদ করছি। একমাত্র ছেলে দেশের বাইরে থাকে। প্রতিমাসে সময়মতো টাকা পাঠিয়েই সে তার দায়িত্ব পালন করে। ঈদের দিন এখানকার অনেকের সঙ্গে গল্প করেছি, নতুন কাপড় পরেছি সঙ্গে ভাল খাবারও খেয়েছি। চাঁদপুর সদরের ইয়াকুব হোসেন। তিনি চাকরি করতেন বিমান বাহিনীর কমিউনিকেশন অফিসার পদে। তার পাঁচ ছেলে এবং দুই মেয়ে। সব ছেলেমেয়েকে তিনি এমএ পাস করিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা বিবাহিত। তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর থাকতেন ঢাকায় ছোট মেয়ের বাসায়। পাঁচ মাস আগে ছোট মেয়ে তাকে এ নিবাসে দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, পেনশনের সমস্ত টাকা তুলে তিনি ছোট ছেলেকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে সেখানে তিন মাসের মতো থেকে দেশে ফিরে আসে। এখন বছরে একবার মেডিক্যাল পেনশন (ভাতা) পান। ঈদে সন্তান-স্বজনদের কেউ দেখা করতে এসেছিলেন কিনা জানতে চাইলে কেউ আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এ নিবাসে আছি, এটা ছোট ছেলে জানে না। ইচ্ছা করেই তাকে বলিনি।’ মেরী মাধুরী খ্রীস্টান ধর্মের অনুসারী। তাই বড়দিন তাদের একমাত্র ধর্মীয় উৎসব। এদিনটিও তিনি বৃদ্ধাশ্রমে এই ছোট্ট ঘরটিতেই কাটান। জানালেন ‘বড়দিন’টিও আমি এ চার দেয়ালের মধ্যেই কাটাই। উৎসবের সময় নতুন কাপড় নিয়ে মেয়েরা দেখতে আসে। কিন্তু ছেলেরা আসে না। মেয়েরাই এসে টাকা, রুম ভাড়া ও খাবারের টাকা দিয়ে যায়। কিন্তু আমার হাত খরচের টাকা দেয় না। আমি বলি এক হাজার টাকা হাত খরচের জন্য দিতে। কিন্তু তারা দেয় না। ছোট নাতি- নাতনিদের দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু উপায় নেই। অনেকবার বলেছি ওদেরকেÑ দু’একদিনের জন্য আমাকে তোরা বাসায় নিয়ে চল। কিন্তু আমাকে তারা বোঝা ভাবে। তাই তো আমাকে এখানে রেখে ঘাড়ের বোঝা সরিয়েছে। প্রায় ৯ বছর ধরে এ নিবাসে অবস্থান করছেন টাঙ্গাইল মির্জাপুরের ফরিদা বেগম। তিনি জানান, টেলিভিশনের মাধ্যমে এ বৃদ্ধাশ্রমের খবর পান এবং ছেলে তাকে এখানে দিয়ে গেছেন। ঈদে কী উপহার পেলেন এবং কী খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে সবসময় ভাল খাবার দেয়া হয়। ঈদে কর্তৃপক্ষ নতুন শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোট দিয়েছে। সকালে সেমাই-মুড়ি, দুপুরে ও রাতে পোলাও, ভাত, মাংস দিয়েছে। তিনি জানান, ঈদে ছেলেমেয়ে কেউ দেখা করতে আসেনি। তাদের জন্য মনটা কাঁদে। আমাদের দেশে দরিদ্র প্রবীণের সংখ্যা শতকরা ৩৭। তাই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা এবং সদস্য দুটোই ধীরে ধীরে বাড়ছে। বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তাদের সকলেই কারও না কারও মা ও বাবা। হিতৈষী প্রবীণ নিবাসে বর্তমানে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৫৪ জন রয়েছেন। এছাড়া, গাজীপুর গিভেন্সি গ্রুপের বৃদ্ধাশ্রম, সাভার বৃদ্ধাশ্রম এবং সমাজসেবা অধিদফতরের বৃদ্ধাশ্রমেও বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা। বৃদ্ধাশ্রমে ভাল নেই তারা। একদিকে স্বজন ছাড়া একাকী জীবন। অন্যদিকে বৃদ্ধাশ্রমের নানা সমস্যা। অন্তত বিশেষ দিনগুলো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানোর ইচ্ছা পোষণ করেন তারা। ঈদেও অনেকের পরিজন তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন প্রবীণ নিবাসের সদস্যদের প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, নিত্যদিন চোখের পানি অবলম্বন করে তারা বেঁচে আছেন। অন্যান্য দিনে তারা যতটা না কষ্ট পান তার থেকে বেশি কষ্ট পান বিশেষ দিনে। তিনি জানান, এ কেন্দ্রের নিবাসীর দেখাশোনার জন্য ২০ স্টাফ রয়েছে। এরা সর্বক্ষণিক তাদের দেখাশোনা করে। কিন্তু মা-বাবার মন সব সময় সন্তানদেরকেই কাছে চায়। ঈদের দিন নিবাসে অবস্থান করা নিবাসীর মধ্যে ৫-৬ জনের স্বজন দেখা করতে এসেছিলেন। আবার অনেকেই ছুটি নিয়ে গেছেন পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে। আমরা তাদের নতুন পোশাক ও ভাল খাবার সরবরাহ করে থাকি। আমি আশা করি, বৃদ্ধাশ্রম যেন কোন বাবা-মায়ের শেষ ঠিকানা না হয়।
×