ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাল্য বিয়ে বন্ধে ৬৪ জেলায় ৬৪ হাজার ৭৬৪ জনের ডাটাবেজ

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৩০ জুন ২০১৭

বাল্য বিয়ে বন্ধে ৬৪ জেলায় ৬৪ হাজার ৭৬৪ জনের ডাটাবেজ

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ১৯২৯ অনুসারে ছেলে ও মেয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১ ও ১৮ হলেও বাংলাদেশে এ বয়সসীমার নিচে ৫২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে থাকে। এর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত গার্লস সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিয়েকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা ও ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেন। সরকারের এ অঙ্গীকার রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘গবর্নমেন্ট ইনোভেশন ইউনিট’ (জিআইইউ) উদ্ভাবনী উপায়ে বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করে যাচ্ছে। আর এ উদ্ভাবন হচ্ছে যিনি বিয়ে পড়িয়ে থাকেন তার সহায়তা ছাড়া কারো পক্ষেই বাল্যবিয়ে অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তাই বিয়ে নিবন্ধক ছাড়া বিয়ে পড়ানোর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে চিন্থিত করে তাদের ডাটাবেজ প্রস্তুত প্রশিক্ষণ, মনিটরিং ও সচেতনতা বৃদ্ধিও মাধ্যমে শতভাগ বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে বাল্যবিয়ে নিরোধকল্পে কাজ করছে জিআইইউ। তারই ধারাবাহিকতায় বাল্যবিয়ে নিরোধে ৬৪ জেলার বিয়ে নিবন্ধক ব্যতীত বিয়ে পড়ানোর কাজে নিয়োজিত ৬৪ হাজার ৭৬৪ জনের ডাটাবেজ প্রস্তুত করে ৪৫ শতাংশের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করেছে জিআইইউ। বাল্যবিয়ের জন্য সচরাচর দারিদ্র্য, অশিক্ষা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি কারণকে দায়ী করা হলেও তা বাল্যবিয়ের মূল কারণ নয় বলে মনে করেন ‘গবর্নমেন্ট ইনোভেশন ইউনিট’র পরিচালক দেবব্রত চক্রবর্তী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, একটি বৈধ বিয়ের জন্য অন্তত বিয়ে পড়াতে হয়। সুতরাং পাত্র-পাত্রীর আইনে নির্ধারিত বয়স না হওয়া পর্যন্ত যে বা যারা বিয়ে পড়ান বাল্যবিয়ের জন্য মূলত তারাই দায়ী। জিআইইউয়ের লক্ষ্য হচ্ছে এদের সচেতন, সক্ষমতা বৃদ্ধি, দায়বদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করে বাল্যবিয়ের হার দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, যে বা যারা বিয়ে পড়িয়ে থাকেন তাদের সংখ্যা মোটামুটি স্থির। যিনি বিয়ে পড়ান বা নিবন্ধন কাজে জড়িত হয়েছেন তিনি দীর্ঘকাল এ কাজে নিয়োজিত থাকবেন। অন্যদিকে, পাত্র-পাত্রীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আমাদের দেশে ১০ থেকে ১৮ বছরের কম বয়স্ক ছেলেমেয়ের সংখ্যা ৩ কোটির বেশি। এছাড়া প্রতিবছর ৪০ লাখ ছেলেমেয়ে ১০ বছরে পদার্পণ করে। এ ব্যাপক ছেলেমেয়েকে উদ্বুদ্ধ ও তদারকি করার চেয়ে বিয়ে নিবন্ধনের দায়িত্ব পালন করা ৭২ হাজার ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধকরণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ। তাই আমরা বাল্যবিয়ে বন্ধে পাত্র-পাত্রী, অভিভাবক, সমাজের চেয়ে বিয়ে সম্পন্নকারীদের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি। জিআইইউ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সরকারীভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিকাহ রেজিস্ট্রার ব্যতীত সচরাচর যে সকল ব্যক্তিবর্গ বিয়ে পড়ান এমন ৬৪ হাজার ৭৬৪ ব্যক্তির ডাটাবেস প্রস্তুত করেছে। সাধারণত মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেম, মৌলভি, ঠাকুর, পুরোহিত, ওঝা, ভান্তে, গুরু, শিক্ষক, মাদ্রাসার উচ্চ শ্রেণীর ছাত্র, চার্চের ফাদার এরা বিয়ে পড়িয়ে থাকেন। সচরাচর বিয়ে পড়িয়ে থাকেন এমন ব্যক্তিদের বিভাগভিত্তিক চিত্র অনুসারে রংপুর বিভাগের অবস্থান সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৫৬৩, এরপর চট্টগ্রামে ১৩ হাজার ৯২৩, তৃতীয় অবস্থানে রাজশাহী ১৩ হাজার ৫০০। এরপর যথারীতি ঢাকা বিভাগে ৯ হাজার ১০৩, খুলনায় ৪ হাজার ৭১৬, ময়মনসিংহ ৩ হাজার ৭৮০, সিলেটে ২ হাজার ৭৫৯ এবং সর্বনি¤œ বরিশালে ১ হাজার ৫৯২। জিআইইউর গবেষণা অনুসারে, বাল্যবিয়ের কারণসমূহ হলো বিয়ের সহজ পদ্ধতি, বিয়ে সম্পাদিত হলে বয়সের কারণে তা কোনভাবে অবৈধ বা বাতিল না হওয়া, বিয়ের সময় প্রয়োজসীয় কাগজপত্রাদি যাচাই ও সংরক্ষণ না করা, বিয়ের একটি বড় অংশ নিবন্ধিত না হওয়া, সরকারী লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত বিয়ে পড়ানোয় সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গকে সচেতন না করা, এফিডেভিট ও কোর্ট ম্যারেজের বিষয়ে ভুল ধারণা ও বিয়েকে সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান মনে করা। বাল্যবিয়ে জনিত সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ডাটাবেজভুক্ত বিয়ে পড়ানোর কাজে নিয়োজিতদের প্রশিক্ষণ প্রদান বিষয়ে জিআইইউর আরেক কর্মকর্তা ড. ইসমত মাহমুদা জনকণ্ঠকে বলেন, জিআইইউ বাল্যবিয়ে নিরোধে ডাটাবেজ ভুক্তদের প্রশিক্ষণে মূলত চারটি বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়- জিআইইউর উদ্ভাবন সম্পর্কে অবহিতকরণ, বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত আইন ও বিধিসমূহ প্রয়োগ কৌশল অবহিতকরণ, ডাটাবেজ প্রস্তুত ও ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা নিরসনে দিকনির্দেশনা প্রদান ও জেলা পর্যায়ের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের দিকনির্দেশনা প্রদান করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া, বিয়ে পড়ানোর সময় পাত্র-পাত্রীর বয়স নিশ্চিত হওয়া, বিয়ে সংক্রান্ত কাগজপত্র সংরক্ষণ, যিনি বিয়ে পড়ান বিয়ে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় তার দায়িত্ব, বাল্যবিয়ে পরিচালনা ও আইনানুগভাবে বিয়ে না পড়ানোর শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ডাটাবেভুক্তদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
×