ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পল্লী চিকিৎসকরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৩০ জুন ২০১৭

পল্লী চিকিৎসকরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন

নিখিল মানখিন ॥ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক পল্লী চিকিৎসক নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। গত কয়েক বছরে দশ লাখ পল্লী চিকিৎসকের মধ্যে প্রায় দু’ লাখের বেশি চিকিৎসক অন্য পেশায় চলে গেছেন বলে পল্লী চিকিৎসক সমিতি জানিয়েছে। পল্লী চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণে সরকারী কোন মনিটরিং নেই। তাদের উন্নয়নে সরকারী পরিকল্পনাও নেই। অথচ দেশের প্রাথমিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন পল্লী চিকিৎসকরা। এমনটি মনে করছেন দেশের চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন, দেশের হাজার হাজার পল্লী চিকিৎকের জন্য কার্যকর সরকারী দিকনির্দেশনা নেই। দেশে চিকিৎসকের সঙ্কট রয়েছে। এমন অবস্থায় দেশের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবাদানে কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডরদের পাশাপাশি পল্লী চিকিৎসকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকারী সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হলে পল্লী চিকিৎসকরা ভুল ও অবৈধ চিকিৎসাসেবায় সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। এই গ্রামাঞ্চলে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার নেই বললেই চলে, ফলে গ্রাম পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্যে পল্লী চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হয়। পল্লী চিকিৎসক বা গ্রাম ডাক্তাররা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ বাড়ির দোরগোড়ায় অত্যাবশ্যকীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পল্লী চিকিৎসকদের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। গ্রামের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে পল্লী চিকিৎসকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমেও পল্লী চিকিৎসকগণ স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, যক্ষ্মা রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা, অপুষ্টিজনিত রোগের চিকিৎসা, যৌনবাহিত রোগের চিকিৎসা, এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ, সকল প্রকার সাধারণ রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে পল্লী চিকিৎসকগণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আমাদের দেশে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় পল্লী চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৃণমূল জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পল্লী চিকিৎসকগণ ভূমিকা রাখতে পারে। পল্লী চিকিৎসকদের ন্যূনতম এসএসসি পাস ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো উচিত। এতে পল্লী চিকিৎসকদের মর্যাদা বাড়বে এবং মানুষের সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে অনেক উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিগণও পল্লী চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন, তাদেরও প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্তমানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। চিকিৎসা পেশা অন্যান্য পেশার তুলনায় স্পর্শকাতর এবং শারীরিক ও মানসিক কষ্ট বা অসুস্থতা তথা জীবন-মৃত্যুর সমস্যার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় ন্যূনতম শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া এই পেশায় নিয়োজিত হওয়া উচিত না। এই বিষয়ে সরকার আগ্রহী ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে পল্লী চিকিৎসক তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির খসড়া জাতীয় সংসদে অনুমোদন হয়েছে। পাশাপাশি এ পর্যন্ত ১১ হাজার ২৬২টি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। সাড়ে ১৩ হাজার সিএইচসিপি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক পুরোপুরি চালু করা প্রয়োজন। কারণ দেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পল্লী চিকিৎসক ও কমিউনিটি ক্লিনিকের ভূমিকা ব্যাপক। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরালো করার দাবি জানিয়েছেন ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি, বিএমএ’র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদী-ই-মাহবুব। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্বল মনিটরিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ী। কেউ কারও দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না। দেশে ভুয়া ডিগ্রীর অভাব নেই, টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে। এতে অদক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। আর যথাযথ মনিটরিং ও সহযোগিতা দানের মাধ্যমে দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় পল্লী চিকিৎসকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। বাংলাদেশ পল্লী চিকিৎসক সমিতির সভাপতি ডাঃ মোঃ সবুজ আলী বলেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ২০১০ সালের ৬১ নং আইনের ১৫(১), ২২ (১) ও ২৯ (১) ধারা উপধারাসহ বিভিন্ন জনবিরোধী পাসকৃত আইনটি সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করা দরকার। পল্লীবাসীদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিভিল সার্জনের অধীন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বছর মেয়াদী পল্লী চিকিৎসক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে। কিন্তু এক শ্রেণীর ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীদের কারণে পল্লী চিকিৎকদের নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার ও নিবন্ধন ছাড়া চিকিৎসা করতে পারবে না এই মর্মে আইন পাস হয়। এতে হাজার হাজার ডিপ্লোমাধারী পল্লী চিকিৎসক চিকিৎসা সেবা প্রদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পল্লী চিকিৎসকরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালু রয়েছে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানায় ছোট্ট চেম্বারে ওষুধ সাজিয়ে বসে আছেন পল্লী চিকিৎসক হোসেন আলী। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, পুরো ধোবাউড়া থানায় প্রায় ২শ’ জন পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। কয়েক বছর আগের ঘটনা। পল্লী চিকিৎসকদের সরকারী ও বেসরকারীভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। অবহেলার শিকার হয়ে অনেক পল্লী চিকিৎসক নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। অথচ এখন পর্যন্ত অনেক দরিদ্র রোগী পল্লী চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন। অভিজ্ঞতার বাইরের রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিই না আমরা। সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেফার করে থাকি। থানা সদর থেকে দূরের এলাকাগুলোতে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে পল্লী চিকিৎসকের বিকল্প এখনও সরকার তৈরি করতে পারেনি বলে দাবি করেন হোসেন আলী। পল্লী চিকিৎসক ছেড়ে কাপড়ের ব্যবসায় নেমে পড়েছেন একই এলাকার মোঃ রুস্তম । তিনি জনকণ্ঠকে জানান, অনেক আশা করে পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। বাজারে গড়ে তুলেছিলাম ছোট্ট একটি ওষুধের দোকান। দোকানের ভেতরেই ছিল রোগী দেখার কক্ষ। প্রাথমিক চিকিৎসা দেখার সব প্রশিক্ষণ পেয়েছি। কিছু ওষুধ বিক্রি হলেও প্রত্যাশিতসংখ্যক রোগী পাওয়া যায়নি। পল্লী চিকিৎসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের পুরোপুরি আস্থা গড়ে উঠেনি। নিজের সীমিত পুঁজি দিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারিনি। বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেলাম বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মোঃ রুস্তম । শুধু হোসেন আলী, মোঃ রুস্তম নন, প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশের সকল পল্লী চিকিৎসক হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
×