ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা ভুগছেন নানা শারীরিক সমস্যায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ জুন ২০১৭

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা ভুগছেন নানা শারীরিক সমস্যায়

নিখিল মানখিন ॥ প্রায় এক মাস আগে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন মোঃ সিরাজ মিয়া (৪২)। রাজধানীর মগবাজারের দিলু রোডের ৪৫/১ হোল্ডিংয়ের ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন তিনি। জ্বর সেরে গেলেও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা রয়ে গেছে। ব্যথার কারণে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না তিনি। এভাবে শুধু মোঃ সিরাজ মিয়া নন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের প্রায় সকলেই ব্যথাসহ শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন। আর এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞদের এমন আশ্বাস পাওয়ার পরও চিকুনগুনিয়া নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত কয়েক মাস ধরে দেশে চিকুনগুনিয়ার টানা প্রাদুর্ভাব চলছে। এ রোগে মৃত্যুর খবর নেই। তবে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শহরাঞ্চল থেকে গ্রামেও আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মৃত্যুর মুখোমুখি না হলেও ব্যথাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কথা বলছেন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা। জ্বর কমে গেলেও ব্যথা ও পা ফুলে যাওয়া রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর মগবাজারের রেড ক্রিসেন্ট গলির ২৮৬/ই হোল্ডিংয়ের বাসিন্দা শ্রীমল চিচাম (৪৮)। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, আক্রান্তের এক সপ্তাহের মধ্যেই জ্বর কমে গেছে। হাত ও পায়ের গিরায় ব্যথা রয়ে গেছে। ডান পায়ের ফোলা পুরোপুরি ভাল হয়নি। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারি না। শরীরে ব্যথা অনুভব করি। নিকটস্থ রাশমনো হাসপাতালের এক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন বলে জানান শ্রীমল চিচাম। তবে এ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া জ্বর নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এতে কারও মৃত্যু ঘটবে না। এই জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসা নিতে হবে। গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত একটি ভাইরাসের নাম। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী মশাই চিকুগুনিয়া ভাইরাস বহন করে। এটি নতুন কোন ভাইরাস নয়। ১৯৫২ সালে প্রথম তানজানিয়ায় রোগটি শনাক্ত হয়। এখন বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে দেখা যায়। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে এই রোগটির প্রকোপ প্রথম দেখা যায়। তবে এর আগে এই রোগটি বাংলাদেশে অন্য নামে পরিচিত ছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, এডিস মশার কারণে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি ও আবহাওয়ার উষ্ণতা বেশি হওয়ায় চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশা দ্রুত বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকা শহরে একটি জরিপ চালানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ৪৭টি ওয়ার্ডে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র দেখেছি। স্বাভাবিক মাত্রার ইনডেক্স ২০ হলেও ঢাকা শহরের ৪৭ ওয়ার্ডের গড় ইনডেক্স ৫২; যা দ্বিগুণের বেশি। অর্থাৎ ঢাকা শহরে এডিস মশার প্রকোপ অনেক বেশি এবং এ কারণে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে অন্য নগরীতে চিকুনগুনিয়ার দু’একটা কেস পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, কামড় খেয়েছে ঢাকায়। কিন্তু জ্বর হয়েছে ঢাকার বাইরে গিয়ে- এমনটিও হয়েছে। এই মুহূর্তে ঢাকা নগরী আতঙ্কের কারণ। সিটি কর্পোরেশনের কর্মী বাহিনী মশক নিধন কর্মসূচী পালন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ মশাগুলো ঘরের ভিতরে থাকে। বাইরে ফগিং করলে তাতে মশা খুব মরছে বলে মনে হচ্ছে না। একই সঙ্গে তাদের কর্মী বাহিনীর সঙ্কট রয়েছে। এ ধরনের দুর্যোগে যে ধরনের কর্মী বাহিনী দরকার তাদের সেটা নেই। আবুল কালাম আজাদ বলেন, চিকিৎসকদের চেম্বারে রোগী আসছে। লক্ষণ হলো অনেক জ্বর, গোঁড়ালিসহ বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা। কেউ কেউ ৪-৫ দিনের মধ্যে সেরে উঠলেও কিছু ক্ষেত্রে ৪-৬ মাসও সেময় লাগতে পারে। অনেকে চলাফেরাও করতে পারে না। এজন্য এটাকে অবজ্ঞা করতে পারি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী মশার প্রকোপ বেড়েছে। ফলে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে। চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। আর প্রায় তা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উঠে যায়। একই সঙ্গে প্রচ- মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। এজন্য গ্রাম-গঞ্জে অনেকে একে ল্যাংড়া জ্বরও বলে। জ্বর চলে যাওয়ার পর শরীরে লাল র‌্যাশ ওঠে। জ্বর ভাল হলেও রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য কোন ভাইরাসে এতটা ভোগান্তি হয় না। সচেতন হতে হবে, তবে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে সতর্কতা হিসেবে করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে ডাঃ অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলছেন, মশার কামড় থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের বারান্দা, আঙ্গিনা বা ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পানি পাঁচ দিনের বেশি জমে না থাকে। এসি বা ফ্রিজের নিচেও যেন পানি না থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু এই মশাটি দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় কেউ ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা মারার জন্য স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোট বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট পরতে হবে, আর সবার খেয়াল রাখতে হবে যেন মশা ডিম পাড়ার সুযোগ না পায়। তাহলেই এই রোগটি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন ডাঃ অধ্যাপক আবদুল্লাহ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকার ধানম-ি, কলাবাগান, গ্রীনরোড, হাতিরপুল, লালমাটিয়া, মালিবাগ প্রভৃতি এলাকা থেকে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে বেশি যাচ্ছে। এছাড়া নারীদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার হার তুলনামূলক বেশি। এই রোগের কোন নির্দিষ্ট প্রতিকার নেই। লক্ষণ দেখে চিকিৎসা ঠিক করা হয়। এ বিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডাঃ তাহমিনা শিরিন বলেন, এ বছর মৌসুমের আগেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তাই মশার উপদ্রব বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য প্রত্যেককে তার আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথাও যেন বৃষ্টির পানি দীর্ঘ সময়ের জন্য জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা রয়েছে।
×