ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমানতে আবগারি শুল্ক হ্রাসে সবাই খুশি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ জুন ২০১৭

আমানতে আবগারি শুল্ক হ্রাসে সবাই খুশি

রহিম শেখ ॥ গ্রাহকদের ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) কমানোর কারণে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, আমানতকারী ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে আমানতকারীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্ক কেটে যাবে। ফলে ব্যাংকমুখী হবে সাধারণ মানুষ। বর্ধিত শুল্কের কারণে ব্যাংকের সঞ্চয় অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার যে প্রবণতা ছিল তা থেকেও সরে আসবেন আমানতকারীরা। এছাড়া অর্থ ‘পাচারের’ যে শঙ্কা ছিল তাও দূর হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। জানা গেছে, গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মহিত। প্রস্তাবে ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্কহার বাড়ানো হয়। এ প্রস্তাবে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ ও সংসদ সদস্যদের তীব্র সমালোচার মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে সরকারও। ফলে শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাব থেকে সরে আসার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে নতুন হার নির্ধারণের সুপারিশ করেন প্রধানমন্ত্রী। আর সেই সুপারিশ আমলে নিয়ে কিছু সংশোধন করে বুধবার সংসদে অর্থবিল পাস হয়। এরপর বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট। ফলে এখন থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতের ওপর কোন ধরনের আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। আর ১ লাখ ১ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতে ১৫০ টাকা এবং ৫ লাখ ১ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতে ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হবে। এছাড়া ১ কোটি টাকার ওপর অন্য স্তরের আবগারি শুল্ক হার অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুসারে রাখা হয়। অর্থাৎ ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ক্ষেত্রে ১২ হাজার এবং ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতিতে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আদায় করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী আনিস এ খান জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষ অনেক কষ্টে অর্জিত টাকা ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে জমা করে। যে টাকা কর পরিশোধিত। আর এ টাকার ওপর কোন ধরনের শুল্ক কাটা উচিত নয়। বিশ্বের অন্য কোন দেশে এ ধরনের শুল্ক নেয় কি না জানা নেই। এ ধরনের শুল্ক যে পরিমাণই হোক না কেন তা সঞ্চয় থেকে কেটে নিলে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হয়। তাই এ ধরনের শুল্ক না রাখাই ভাল। এরপরও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্কের বর্ধিত হার কমানোকে স্বাগত জানাই। এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। এ বিষয়ে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমীন জনকণ্ঠকে বলেন, একদিকে ব্যাংকের ডিপোজিট রেট (আমানতের সুদহার) হ্রাস পাওয়া এবং অন্যদিকে আবগারি শুল্ক বর্ধিতহার আমানতকারীদের আতঙ্কিত করেছে। তারা মনস্তাত্ত্বিক চাপে ছিল। দেশের মানুষকে ব্যাংকমুখী করার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা বাধাগ্রস্ত হতো। সরকার বাজেটে আবগারি শুল্কের বর্ধিতহার কমিয়েছে। তা আগের তুলনায় আরও সহজ করেছে। এজন্য রাজস্ব আহরণ কম হলেও জনকল্যাণের জন্য এ সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকে জমার ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের কোন যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, এ কর কোথাও নেই। মূল্যস্ফীতির ফলে ব্যাংকে জমা আমানতের টাকা খোয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে আবগারি কর আরোপ করে মূল টাকা আরও কমানো ঠিক হবে না। তবে এটি অনেক কমানো হয়েছে, এটি গোটা ব্যাংকিং খাতের জন্য ইতিবাচক বলে তিনি মনে করেন। সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, জামানতের ওপর আবগারি শুল্ক হ্রাস করা দরকার ছিল। কেননা ব্যাংকে জামানত রাখা অর্থ সাধারণত আয়করসহ বিভিন্ন শুল্ক দেয়ার পরই রাখা হয়। এর ওপর যদি আবার আলাদা শুল্ক দিতে হয়, তাহলে জামানত রাখায় আগ্রহ হারাবে মানুষ। এদিকে আবগারি শুল্ক নিয়ে মিজানুর রহমান মোল্লা নামে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক সময় ক্যাশ টাকা ব্যাংকে লেনদেন করতে হয়। এখান থেকে যদি সরকার টাকা কেটে নেয় তাহলে কোথায় টাকা রাখব। যাই হোক শুনেছি আবগারি শুল্ক কমিয়েছে সরকার। এটা ভাল হয়েছে। এতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের উপকার হবে। ব্যাবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেটে এমন স্পর্শকাতর বিষয়গুলো আগে থেকে গবেষণা ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। এগুলো না হলে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। আর ব্যাংকে জমার ওপর আবগারি শুল্ক হ্রাস পাওয়ায় সাধারণ জনগণ ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাবেন। তাই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকার প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে। এটিও ইতিবাচক। সব মিলিয়ে বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তনে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। উল্লেখ্য, ব্যাংকে আমানত আছে ৮ কোটি ৪২ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬ জন গ্রাহকের। যার মধ্যে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৯ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট এক লাখ টাকার নিচে। বাকি ৮ কোটি ৯ লাখ ৯১ হাজার ৪৭ জন গ্রাহককে আবগারি শুল্কের আওতায় আসতে হবে। এ ছাড়া ঋণ হিসাব আছে ১০ কোটি ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ১৭টি। যার মধ্যে ৮০ লাখ ৩৯ হাজার ৪৫ জন গ্রাহকের ঋণ আছে এক লাখ টাকার নিচে। বাকি সব গ্রাহকের আবগারি শুল্কের আওতায় আসতে হবে। যার মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ২৮ জন গ্রাহককে সর্বনিম্ন আবগারি শুল্ক ১৫০ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
×