ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভ্যাট আইন স্থগিত করায় বিনিয়োগ বাড়বে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ জুন ২০১৭

ভ্যাট আইন স্থগিত করায় বিনিয়োগ বাড়বে

এম শাহজাহান ॥ ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করায় দেশে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, জনগণের সরকার জনবান্ধব বাজেট দিয়েছে। ভোটারদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। এই বাজেট পাসের ফলে আপাতত মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের দাম আর বাড়ছে না। এছাড়া আমানতের ওপর আবগারি শুল্কহারে পরিবর্তন আনায় ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে এই আইনটির খারাপ দিকগুলো বাদ দিয়ে সংশোধন করার তাগিদ দিয়েছে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভ্যাট আইন স্থগিত হওয়ায় বেসরকারী খাত উৎসাহিত হলেও সরকারী বিনিয়োগ কমার আশঙ্কা আছে। কারণ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হলে তারও একটি প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতিতে। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ভ্যাট আইন দু’বছরের জন্য জন্য স্থগিত হওয়ায় বেসরকারী খাতে স্বস্তি ফিরে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরে এসেছে। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, এতে দেশে বাড়বে কর্মসংস্থানও। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যে জনগণের সরকার এই বাজেট পাসের মাধ্যমে আবারও তা প্রমাণ হলো। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ট্যাক্স ও ভ্যাট না বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকারের আওতা বাড়ানোর দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বেসরকারী খাত সরকারকে সহযোগিতা করবে। আইনটি স্থগিত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা দূর হয়েছে। তবে ভ্যাট আইন নিয়ে দু’বছর পর কি হবে সেটা নিয়েও ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ রয়েছে। তাই আইনটির খারাপ দিকগুলো বাদ দিয়ে ভাল বিষয়গুলো রাখতে হবে। তাই আগামী দু’বছর স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বসে আইনটির সংশোধনী আনতে এখন থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কাজ শুরু করতে হবে। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন না নিয়ে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের মতামত গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। এদিকে, ভ্যাট আইন স্থগিত ও আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার হওয়ায় ঢাকার শীর্ষ বাণিজ্যিক সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ডিসিসিআই বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকে জমাকৃত টাকার ওপর আবগারি শুল্ক প্রায় ৬০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় এবং এ সিদ্ধান্ত সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সমাজে হতাশা তৈরি করে। এছাড়া ভ্যাট আইন কার্যকরের ঘোষণা থাকায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন। এই বাস্তবতায় পাসকৃত অর্থবিলে বিদ্যমান মূসক আইনকে আরও দুই বছরের জন্য বলবত রাখার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে সংগঠনটি। ব্যাংকে জমাকৃত আমানতের পরিমাণ ১ লাখ হতে ৫ লাখ টাকার ওপর আবগারি শুল্ক ৮০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০ টাকা এবং ৫ লাখ হতে ১০ লাখ টাকার ওপর আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা নির্ধারণ করায় ডিসিসিআই সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছে। ডিসিসিআই মনে করে, জাতীয় সংসদে পাস হওয়া অর্থবিলে প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পরিবর্তে পূর্বের ভ্যাট আইন বলবত রাখায় দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বেসরকারী বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা হ্রাস পাবে। বর্তমানে ২০টি সেবা খাত স্তরভিত্তিক মূসক সুবিধার আওতায় রয়েছে এবং ১৭৯টি পণ্য ট্যারিফ ভ্যালু সুবিধার আওতায় রয়েছে। বিদ্যমান ভ্যাট আইন বহাল রাখার ফলে নির্মাণ সামগ্রী, বিস্কুট, জুস, মসলা, পরিবহন, এ্যাপার্টমেন্ট, আসবাবপত্র, তথ্য-প্রযুক্তি সেবা, বিদ্যুত এবং রেস্তরাঁ প্রভৃতি খাতের দাম বাড়বে না। পাশাপাশি ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক হ্রাস করায় দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত আয়ের জনগণ সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হবে এবং এসএমই খাত মূলধন সংগঠনে আস্থা ফিরে পাবে, যা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হারে জিডিপি অর্জনে সহায়ক হবে। এদিকে, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করায় এলোমেলো পরিস্থিতিতে বাজেট কাঠামো থেকে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাজেটের ঘাটতিজনিত প্রক্রিয়ায় সমন্বয় এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজেটে রাজস্ব আদায় আয়কর থেকে ৩৬ শতাংশ এবং ভ্যাট থেকে ৩৩ শতাংশ লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। এই জায়গায় এখন একটি চাপ তৈরি হবে। তবে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না করে পিছিয়ে দেয়ায় সরকার এক ধরনের নতি স্বীকার করেছে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ভ্যাট আইন নিয়ে বড় সংস্কারের যে লক্ষ্য ছিল, তা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারল না বর্তমান সরকার। এটা এক ধরনের ব্যর্থতা। তিনি বলেন, আইনটি দু’বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, বাদ দেয়া হয়নি। তাই আইনটি ভবিষ্যতে বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের মতামত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করতে হবে। এদিকে, ভ্যাট আইন স্থগিত হওয়ায় ব্যবসায়ী সমাজের আস্থা ফিরে এসেছে বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ। তিনি বলেন, ভ্যাট আইন থেকে সরকার সরে আসায় জিনিসপত্রের দাম আর বাড়বে না। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। এছাড়া ব্যাংক আমানতের আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরল ঘোষণা। এতে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। সংগঠনটির সাবেক প্রথম সহসভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে আইনটি স্থগিত করার দাবি জানিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে ঘোষণা আসায় উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতার সঙ্কট দূর হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করছি, আইনটি সংশোধনে এনবিআর স্টেক হোল্ডারদের মতামত গ্রহণ করবে। বিনিয়োগ ॥ এদিকে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী (এফডিআই) বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় বেসরকারী খাত উৎসাহিত হচ্ছে না। বরং টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। এই বাস্তবতায় নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত হওয়ায় দেশের বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ভ্যাট আইন স্থগিত একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তাদের এই বাজেট পাসের মাধ্যমে আস্থা ফিরে এসেছে। এদিকে, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সম্প্রতি বলেছে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছেÑএটাই এই মুহূর্তের জন্য সুসংবাদ। তবে এফডিআই আকর্ষণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আঞ্চলিক কানেকটিভিটিসহ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে পিছিয়ে পড়লে ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া এবং ফিলিপিন্সের মতো রাষ্ট্রগুলো বড় প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় দেশ। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ভারত, চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো রাষ্ট্রের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরী হয়ে পড়ছে। এছাড়া ২০১৭ সালে বাংলাদেশের এফডিআই পরিস্থিতি আরও ভাল হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আঙ্কটাড। বিশেষত প্রতিবেশী ভারত এবং চীন থেকে বাংলাদেশে এফডিআই বাড়তে পারে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সাল বিশ্ববিনিয়োগের মন্দার বছর গেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের এফডিআই খুব কম বলা যাবে না। তবে জিডিপি অনুপাতে এ হার আরও বাড়ানো উচিত। তিনি বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক হারে কাজ করছেন তারা। উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন সহজেই মেটানোর পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। ফলে আগামীতে এফডিআই অনেক বেশি পরিমাণে বাড়বে।
×