ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমৃদ্ধির পথে বহুদূর

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৩০ জুন ২০১৭

সমৃদ্ধির পথে বহুদূর

একটা রাষ্ট্রের বাজেট প্রণয়ন কখনওই সহজ কাজ নয়। একটি ছোট সংসারেও সারা বছরের হিসাব মেলানো কঠিন, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়। তাই যারা রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রণয়ন করেন, তারা অনেক কঠিন কাজটি করেন বলেই মনে হয়। যখনই রাষ্ট্রীয় বাজেট পেশ হয়, ব্রিফকেস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে প্রবেশের দৃশ্যটিতে আমরা অভ্যস্ত। এ যেন বাজেটের এক অনন্য প্রতীকী চিত্র। আবার বাজেট পেশের পরদিন সংবাদপত্রে কোন্্ ‘জিনিসের দাম বাড়ল, কোন্্ জিনিসের দাম কমল’ শিরোনামের সংবাদের দিকে অনেকের মতো চোখ থাকে আমারও। প্রতি বছরের মতো এ বছরও জাতীয় বাজেট পেশ হলো। বাজেট বক্তৃতায় অনেক দূর যাওয়ার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। বক্তৃতায় রূপকল্প-২০৪১-এর আওতায় সরকার দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই প্রেক্ষিত পরিকল্পনার স্বপ্নমূলে থাকবে একটি শান্তিপ্রিয়, উন্নত এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুস্থ-সবল বাংলাদেশ। কারণ, উন্নয়নের পথে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়ার একটা কমিটমেন্ট এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। স্বাধীনতার পর আমাদের যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, নানা বিপত্তিতে ততটা এগিয়ে যাওয়া হয়নি। এখন এগিয়ে যাওয়ার, উন্নয়নের পথে অগ্রসরের যে ধাপ চলছে, এর গতি যত অব্যাহত থাকবে, ততই মঙ্গল। দেশের সবচেয়ে বেশি বাজেট পেশের সুযোগ পেলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রীর হাতে একটি জাতির ১১টি বছরের বাজেট পেশ নিঃসন্দেহে তার অনন্য যোগ্যতারই পরিচয়। ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি, একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়’ বঙ্গবন্ধুর বই থেকে এ উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৪ সালে আমাদের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, মতান্তরে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। আজ বলতে দ্বিধা নেই, প্রবৃদ্ধির এ ধারা যদি অব্যাহত থাকত, তাহলে আমরা ১৯৯৬-’৯৭ সালেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারতাম। আর এখন আমাদের অবস্থান থাকত অনেকটা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে।’ ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৯ রাষ্ট্রীয় এই শাসন অধ্যায়ের অর্থনৈতিক চিত্রও ভেসে ওঠে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। ‘দিন বদলের সনদ’, বিপুল সফলতার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া ২০১৫ সালের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি), এরপর শুরু হওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি), ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্পের সবই উঠে আসে বাজেট বক্তৃতায়। আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার পথ মোটেও কুসুুমাস্তীর্ণ নয়। রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যাপক সম্পদ ধ্বংস, অশুভ তৎপরতার মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ভীতি প্রদর্শন, বিশ্ববাসীর কাছে দেশকে একটি সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের চাকা সচল রেখেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়রূপে অটল হিমালয়ের মতো চির উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, কর্মসৃজন, খাদ্য উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আমদানি ও রফতানি কোন সূচকেই আমরা আর পিছিয়ে নেই। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন খাতে। দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসসহ আর্থসামাজিক খাতের প্রায় প্রতিটি সূচকেই রয়েছে আমাদের সাফল্য। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বীকৃতিতে ধন্য আমার প্রিয় দেশ। বিশ্বব্যাপী সুধী সমাজে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম প্রথম সারির দেশ। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সীমিত সম্পদের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দারিদ্র্য বিমোচন করে বাংলাদেশ বিশ্বসমাজে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এত সব সাফল্য ও অর্জন বাংলাদেশকে আজ এক অনন্য উচ্চতায় এনে দাঁড় করিয়েছে। অর্থমন্ত্রী দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায় এসব অগ্রসরমান কর্মকা-ের অব্যাহত ধারার কথাই মনে করিয়ে দিলেন আমাদের। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদ, পঁচাত্তরের কালরাত্রিতে ইতিহাসের জঘন্য ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার বঙ্গবন্ধুর নিষ্পাপ স্বজন ও অন্য শহীদদের স্মরণ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সমৃদ্ধির পথে হাঁটছি। সোনা ছড়ানো সমৃদ্ধি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সময় এসেছে সাহসী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আলোর পথে অভিযাত্রার। ২০৪১-এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের ৮-১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এ জন্য উৎপাদনের উপকরণ পুঞ্জীভূতকরণের পাশাপাশি এগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে ব্যাপকভাবে। নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত ব্যবস্থাপনার আওতায় দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আনতে হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। নিশ্চিত করতে হবে উৎপাদন নৈপুণ্যের উৎকর্ষায়ন।’ স্কুলজীবনে আমরা এইম ইন লাইফ বা জীবনের লক্ষ্য শিরোনামের রচনা তৈরি করেছি। যদি লক্ষ্য স্থির ও সঠিক থাকে, তবে তা ফলোদয় হতে বাধ্য। বর্তমান সরকারের বাজেট পেশকালে আমরা প্রতি অর্থবছরেই একটি সুন্দর শিরোনামের সঙ্গে পরিচিত হই। যদিও নামে কিছু এসে যায় না, কাজই আসল। তারপরও একটি সুন্দর শিরোনাম অনেক অর্থ বহন করে। যে শিরোনামটি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে পজিটিভ ভাবনা তৈরি করে দেয়। এ বছরের বাজেটের সেøাগান হচ্ছে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের।’ গত বছরের বাজেটের শিরোনাম ছিল ‘প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রযাত্রা।’ এমন ভাল লক্ষ্য থাকলে তা আমাদের ভাল পথটিতে যেতেই উৎসাহ জোগাবে। এবারের বাজেটকে কেউ বলেছেন উচ্চভিলাষী, আবার কেউ বলেছেন এমন বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব। এ নিয়ে স্বপ্নই দেখা যেতে পারে শুধু। চার লাখ কোটি টাকার বাজেট মোটেও উচ্চাকাক্সক্ষী নয়, এমনও বলছেন কেউ কেউ। এসব কথা থেকে আমার মনে হয়েছে বাজেটে সুউচ্চ কোন অগ্রসর ভাবনা হয়ত ভাবা হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা পজিটিভ। কারণ স্বপ্ন তো আমাদের দেখতেই হবে। স্বপ্ন না দেখলে তা পূরণ হবে কী করে! আমরা তো স্বপ্ন দেখারই জাতি। আমরা ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি বলেই আজ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে পৌঁছে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পেরেছি। আমরা জানি, আগামী দিনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। বিনিয়োগ একটি দেশের উন্নয়নের ভিত রচনা করে। আর সরকার এখন সে পথটিতেই হাঁটছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় কবি রবার্ট ফ্রস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করেছেন, ‘আমাদের যেতে হবে বহুদূর’। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলব আমরা বীর জাতি, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যের পথ বেয়ে, দেশপ্রেমের আদর্শ বুকে ধারণ করে, সমৃদ্ধির পথে যেতে চাই বহুদূর। এবার বাজেটে মোট বরাদ্দের ১৬.৪ শতাংশ দিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে বরাবরের মতো এক নম্বরে রাখা হয়েছে। ১৩.৬ শতাংশ পেয়ে আছে দ্বিতীয় স্থানে জনপ্রশাসন, ১২.৫ শতাংশ বরাদ্দ নিয়ে পরিবহন ও যোগাযোগের স্থান তৃতীয়, সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ১০.৪ শতাংশ (চতুর্থ), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ৬.৯ শতাংশ (পঞ্চম), প্রতিরক্ষায় ৬.৪ শতাংশ (ষষ্ঠ), কৃষিতে ৬.১ শতাংশ (সপ্তম), সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ৬.০ শতাংশ (অষ্টম), জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৫.৭ শতাংশ (নবম), বিদ্যুত ও জ্বালানিতে ৫.৩ শতাংশ (দশম), স্বাস্থ্যে ৫.২ শতাংশ (১১তম), শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ১.০ শতাংশ (১২তম), বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্মে ০.৯ শতাংশ (১৩তম), আবাসনে (১৪তম) এবং বাকি ২.৭ শতাংশ বিবিধ খরচে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। এই হচ্ছে এক নজরে এবারের বাজেটচিত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করে ১৯৭২ সালে। সেই বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ৪৫ বছর পর জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই আবার বাংলাদেশের ৪৬তম বাজেট পেশ করে, যার আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এটি দেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের সর্ববৃহৎ বাজেট। আওয়ামী লীগ প্রদত্ত প্রথম বাজেটের তুলনায় ৪৬তম বাজেট ৫১০ গুণ বড়। বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা না ঘটলে বাজেটের আকার এতদিনে হাজার গুণ বাড়ত। তারপরও জাতির পিতার উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গত ৮টি অর্থবছর ধরে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে এবং এই সচলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের মহাসড়কে আরোহণ করেছে, তাতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। ক্রমেই সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে দেশ। সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের বৃত্তটি ভেঙ্গে দিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্নকে বাস্তবে তালুবন্দী করতে চান। আর ২০২১ সাল থেকে ৩ বছরের পথ এগিয়ে এসে ২০১৮ সালের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়তে চান বাংলাদেশকে। প্রস্তাবিত বাজেটটি ২০১৭-’১৮ অর্থবছরের, যাতে অর্থমন্ত্রী একটি উন্নত এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সুস্থ-সবল আলোকময় বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ চোখে পড়ার মতো। উন্নয়নের সব সূচক উর্ধগামী। এক সময় যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলত, আজ তারাই বলছে, বাংলাদেশ উন্নয়নের বিস্ময়। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থায়ন না করলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে যায়নি, নিজস্ব অর্থে তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করছে। এমন অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। মধ্য আয়ের মহাসড়কে বাংলাদেশ এখন দৃপ্ত পায়ে ছুটে চলেছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এটাই এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা শুধু দেশবাসীকে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও এ বিশ্বাস জন্মিয়েছে যে, সঠিক ও যুগোপযোগী পরিকল্পনা এবং আত্মপ্রত্যয় থাকলে উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। লেখক : সচিব, বাংলাদেশ সরকার
×