ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট্ট একটি পর্দা সবকিছুকে আপন করে নিয়েছে...

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৯ জুন ২০১৭

ছোট্ট একটি পর্দা সবকিছুকে আপন করে নিয়েছে...

সমুদ্র হক ॥ ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি...’। পকেটে, মুঠোয় ও ঘরের ছোট্ট একটি পর্দা (স্ক্রিন) পারিবারিক ছিন্ন বন্ধনকেও বেঁধে দিয়েছে। আত্মীয়তা, বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরও আপন করে দিয়েছে। এবারের ঈদ তাই দেখিয়ে দিল। একটা সময় ঈদের বড় আনন্দ ছিল আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। দুই দ- বসে কথা বলা। আতিথেয়তার পালায় সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়া। এখন সবকিছুই যন্ত্রে। পকেটের স্মার্ট ফোন আরও স্মার্ট করেছে। বহনযোগ্য ট্যাব এনেছে গতি। ল্যাপটপ দূরকে এনেছে নিকটে, ঘরের মধ্যে। গানের কথার মতো-আমি আপন হতে চাহিনী তুমি তো আপন হয়ে গিয়েছো। বছর দুই আগেও ঈদে মোবাইল ফোনগুলোর একদ- বিরতি থাকত না। ঈদের আগের দিন থেকে টেক্সট মেসেজের (এসএমএস) হিড়িক পড়ে। তারপর ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে সেল ফোনে কথা বলা ছিল সাধারণ বিষয়। ঈদের দিন ও পরের দিন এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ছিল যেন বাধ্যতামূলক। কোথাও না গেলে মনটি উসখুস করে উঠত। যুগের পরিবর্তনে এসব কিছুই দ্রুত পুরানো হয়ে গিয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম প্রতিনিয়ত খুঁজে বের করছে বিকল্প কিছু। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে কোন উপায় না দেখে প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে মধ্যবয়সীরা। এছাড়া কোন উপায় নেই। প্রযুক্তির সঙ্গে চলতে না পারলে শুধু পিছনে নয় কোনভাবেই এগিয়ে চলা যাবে না। লক্ষ্য করা যায়, নগর জীবনে (কোথাও বিদ্যুতায়িত উন্নত গ্রামে) এবারের ঈদে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কম্পিউটার (ল্যাপটপ ডেস্কটপ) ট্যাব ও স্মার্ট ফোনের স্ক্রিন বা মনিটর সচল ছিল। ডিজিটাল ডিভাইসের এই যন্ত্রগুলোর কোন বিশ্রাম ছিল না। আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব সকলের উপস্থিতি ছিল এই ক্ষুদে পর্দায়। প্রবাসী আত্মীয়স্বজনরাও এসেছিল পর্দায়। কে কোথায় কি করছে। কিভাবে ঈদ কাটাচ্ছে। তার খুঁটিনাটির ভিডিও আলাপ। মনে হবে তারা বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। ভিডিও কনফারেন্সও হচ্ছে। ঢাকার আত্মীয়স্বজনরাও এই পর্দায় উপস্থিত হয়ে কুশলাদি বিনিময় করছে। ঢাকার বাইরের স্বজনরাও ঢাকার সঙ্গে একইভাবে যোগাযোগ রেখেছে। মনে হবে প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠেছে ঈদে ভিডিও কনফারেন্সের আসর। ইন্টারনেট, স্কাইপি, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও তার মেসেঞ্জার ঈদের দিন ও পরদিন টানা সচল ছিল। মনে হবে ঈদের বেড়ানো কেড়ে নিয়েছে এই ডিজিটাল ডিভাইস। ঘরে বসেই আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়ানোর আনন্দ। এই আনন্দ যদিও যান্ত্রিক তারপরও লাইভ। এখনই বলাবলি হয়, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আত্মীয়তার মিষ্টি বন্ধনও যান্ত্রিক হয়ে উঠবে। একটা সময়ের একান্নবর্তী পরিবারগুলো খ-িত হয়ে নিউক্লিয়ার ফ্যামলিতে পরিণত হয়েছে। এই পরিবারগুলোর বন্ধনেও ভাটা পড়ছে। ঢাকা মহানগরীগুলোতে এক ফ্লাটের লোক আরেক ফ্লাটের খবর রাখে না। এই ঢেউ ঢাকার বাইরের বড় নগরীগুলোতেও গিয়ে ঠেকছে। ‘পাড়া পড়শী’ বলে যে উপাখ্যান ছিল তাও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বনেদী পরিবারের সেকেন্ড ও থার্ড জেনারেশনের মধ্যে দেখা সাক্ষাত কমে গিয়েছে। কে কোথায় থাকে, কি করছে বিয়ে থা করছে কি না, কয় ছেলে মেয়ে এই খবরগুলোতেও ভাটা পড়েছে। কালেভদ্রে দেখা সাক্ষাত হলে খোঁজখবর নেয়া হয়। এমনও দেখা যায় পরিচিতজন, স্বজন অনেকদিন আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে সেই খবরও অজানা রয়ে গেছে। ডিজিটাল ডিভাইস আর আকাশের উপগ্রহ এই বন্ধনকে কাছে টানছে। সব কিছুই চলে আসছে ছোট্ট যন্ত্রের ছোট্ট একটি পর্দায়। এই অনুভূতি যদিও কৃত্রিম। তারপরও যুগের পরিবর্তন কৃত্রিমতাকেই লাইভ করে তুলছে দিনে দিনে।
×