ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবার ঈদ যাত্রায় স্বস্তি ॥ অল কোয়াইট অন অল ফ্রন্ট

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৯ জুন ২০১৭

এবার ঈদ যাত্রায় স্বস্তি ॥ অল কোয়াইট অন অল ফ্রন্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শেষ মুহূর্তে ঘরে ফেরায় ভোগান্তি অনেকটাই কম ছিল। এক কথায় বলছে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন ঘরমুখো মানুষ। ফেরিঘাট, সড়ক, রেল-নৌ-পথে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ায় এ স্বস্তি মিলেছে। এতে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা। সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, এবারের ঈদযাত্রা ছিল নিকট অতীত ইতিহাসের সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাও বলছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সব পথেই ভোগান্তি কমেছে। এদিকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন নগরীর মানুষ। অফিস শুরুর প্রথম দিন বুধবার রেলপথে বেশি মানুষ ঢাকায় ফিরেছেন। কমলাপুর রেল স্টেশনে বেশি মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এখনও শুনশান নীরব মেগাসিটি ঢাকা। আগামী সপ্তাহ থেকে ফের জমে ওঠবে ঢাকা এমন কথাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সড়কপথের যাত্রীরা বাড়তি বাস ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন। ঢাকায় ফিরতে টিকেট সংগ্রহে ভোগান্তির কথাও জানিয়েছেন অনেকে। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরেই ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়ি ফিরতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এ বিবেচনায় অনেকেই আগে ভাগে পরিবার-পরিজনকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। রেশনিং পদ্ধতিতে গার্মেন্টস ছুটি দেয়ায় অনেকটা স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন যাত্রীরা। অন্যান্য বছর দেখা যায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-সাভার ও গাজীপুরের সকল গার্মেন্টস একদিনে ছুটি দেয়ায় সড়কের ওপর বাড়তি চাপে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব পড়ে অন্যান্য রুটেও। ফেরিঘাটের যানবাহন পারাপারে ভোগান্তির চিত্র অনেক পুরনো। এবছর গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়। যাত্রীবাহী পরিবহনের জন্য আলাদা ফেরির ব্যবস্থা ও দ্রুত বাস পারাপারের ব্যবস্থাও ছিল ঘাটগুলোতে। সিরিয়ালের নামে কেউ যেন পরিবহন থেকে বাড়তি টাকা আদায় করতে না পারে এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়। দ্রুত টিকেট কাটারও ব্যবস্থা ছিল ঘাটগুলোতে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর সড়কপথের অবস্থা ছিল তুলনামূলক ভাল। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলো ছিল যানবাহন চলাচলের উপযোগী। তবে ঈদের অন্তত ১০দিন আগে থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। মূলত গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়া ও ফোর লেনের কাজসহ সড়ক সংস্কার না হওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। সংবাদমাধ্যমে বিষয়গুলো তুলে ধরা হলে শেষ পর্যন্ত এই রুটের ফোর লেনের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। সড়কের দু’পাশ থেকে তুলে নেয়া হয় নির্মাণ সামগ্রী ও মাটি। অবৈধ বাস টার্মিনালসহ বাজার উচ্ছেদ করা হয়। ওয়েস্কেল ও বিভিন্ন সেতুর লেন ছোট হওয়ায় সড়কপথে যানজটের ভোগান্তি হচ্ছিল। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-টাঙ্গাইল রুটে এ সমস্যা দেখা দেয়। সিলেট মহাসড়কেও বাইপাস রুটগুলোতে যানজটের ভোগান্তি লক্ষ্য করা গেছে। যা আরও বাড়িয়ে তোলে ধারাবাহিক বৃষ্টি। সর্বশেষ ২২ জুন থেকেই বৃষ্টিপাত কমতে শুরু করে। এটিও স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রার অন্যতম কারণ। খোদ সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নিজেও বলছিলেন, বৃষ্টি হলে ভোগান্তি বাড়বে। একেবারে স্বস্তির ঈদযাত্রার নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয় এমন কথাও বলেছিলেন মন্ত্রী। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীরাও এমন ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন। অতিবৃষ্টির কারণে টঙ্গী-চান্দনা পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের অংশ ডুবে যায়। এতে যানজটের মাত্রা তীব্র হয়েছিল। যা পরবর্তীতে স্বাভাবিক হয়ে আসে। টঙ্গী-চান্দনা চৌরাস্তা, চন্দ্রা, আশুলিয়া, সাভার, বাইপাইল, ভোগড়া বাইপাসসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বাড়তি জনবল মোতায়েন করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী, ভুলতা, গাউসিয়া, রূপগঞ্জ, কাঁচপুর-মেঘনা সেতুসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে ছিল বিশেষ নজরদারি। এছাড়া অন্যান্য বছরের তুলনায় মহাসড়কের সড়ক দুর্ঘটনা কম হয়েছে। এতে যানজটের ভোগান্তি কম ছিল। এবারের ঈদে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা রংপুরের পীরগঞ্জে। একটি পণ্যবাহী সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে ৫০ জনের বেশি মানুষ বাড়ি ফিরছিলেন। পথে দুর্ঘটনায় ১৭ জন মারা যান। এর পরপরই সংবাদ মাধ্যমে ওঠে আসে পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রী পরিবহনের বিষয়টি। এবার পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রী পরিবহন করা হলেও অন্য বারের চেয়ে তুলনামূলক কম দেখা যায়। মহাসড়কে রাজধানীতে চলাচলরত বাসগুলোও কম দেখা গেছে। সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি যেমন প্রয়োজন তেমনি ব্যবস্থাপনাও জরুরী। এবারের ঈদ যাত্রার শুরুতে দুটি বিষয়েরই ঘাটতি দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে কঠোর হলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তাই ঈদ উৎসবের সময় রাস্তা সংস্কার, সড়কের দু’পাশে ড্রেনের ব্যবস্থা, হাটবাজার ও টার্মিনাল উচ্ছেদ, স্বল্পগতির ও নিষিদ্ধ যানবাহন কোন অবস্থাতেই চলতে না দেয়া। যানজট নিরসনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল মোতায়েন করতে হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দুর্ভোগমুক্ত ঈদ যাত্রা নিশ্চিত করা কঠিন কোন বিষয় নয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, প্রতিবছরই নিরাপদ ঈদ যাত্রা নিশ্চিত করতে প্রস্তুতি নেয়া হয়। এবছরও বেশ প্রস্তুতি ছিল সব সেক্টর থেকেই। প্রস্তুতি অনুযায়ী কাজ হওয়ায় মানুষ স্বস্তিতে বাড়ি ফেরার সুযোগ পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি উপকার হয়েছে বৃষ্টি না হওয়ায়। রাস্তা ভাল থাকলেই হবে না, বৃষ্টি হলে ভোগান্তি বাড়ত। যা রোধ করার কোন ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, আমি মনে করি সব পক্ষ থেকেই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা গেলে ঘরে ফেরা মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়া সম্ভব। রেল-নৌ-পথ রেল ও নৌ-পথে ভোগান্তি ছিল তুলনামূলক কম। ২২ জুন ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় কিছুটা হয়েছিল। এরপর অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল ট্রেন যাত্রা। ছুটি বেশি হওয়ায় আগে ভাগেই রেলপথের যাত্রীদের অনেকেই বাড়ি ফেরেন। তাই অন্য বছরের তুলনায় এবার শেষ পর্যন্ত যাত্রী কমই ছিল। ২৫ জুন দুপুরের পর অনেক ট্রেনের আসন ফাঁকা ছিল। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের বেশিভাগই নৌ-পথ ব্যবহার করেন। তাই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে উপচেপড়া ভিড় ছিল যাত্রীদের। প্রতিদিন ১৬০টির বেশি লঞ্চ নদী বন্দর ছেড়ে যায়। বাড়তি যাত্রী রোধে বন্দর কর্তৃপক্ষ বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। তবে অন্যান্য বছরের মতো এবছর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করায় নৌ-পথে ভোগান্তি ও দুর্ঘটনা কম হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ঈদযাত্রা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক মনে হয়েছে। তিনি বলেন, যানজট-জলজট ও সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আমরা বারবার নানা আশঙ্কাও ভোগান্তির কথা বলে আসছিলাম। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিও কমেছে। কমেছে যানজটও। সড়ক দুর্ঘটনাও তেমন একটা হয়নি। ফলে অনেকটা স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন মানুষ। এখন কর্মস্থলে স্বস্তি নিয়ে ফিরতে পারলেই আমরা খুশি। আশাকরি সবাই হাসি মুখেই কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন। বিআইডব্লিউটিসি পাটুরিয়া কার্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঢল ছিল পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকায়। গত শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় কিছু যানবাহন থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকায় যানবাহনের অপেক্ষমাণ কোন লাইন ছিল না। যানবাহনগুলো সরাসরি এখন ফেরিতে ওঠার সুযোগ পায়। ঘাট এলাকায় ছোট গাড়ি ও বাসের চাপ কমে যাওয়ায় গুরুত্ব অনুযায়ী পণ্যবাহী আটকে পড়া ট্রাকগুলোকে ফেরি পার হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। ঈদ উপলক্ষে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ১৭টি ফেরি দিয়ে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার শুরু হলেও পরে যোগ করা হয় আরও দুটি ফেরি। এদিকে ঢাকা-আরিচা ঘাটেও শেষ মুহূর্তে যানজটের খুব একটা ভোগান্তি হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শেষ মুহূর্তে যারা বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেন তাদের ঘাট এলাকায় ঈদ করতে হয় এরকম দৃশ্য বহু বছর দেখেছেন তারা। এর প্রধান কারণ হলো যানজট। মূলত অতি বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর ঘাট ভেঙ্গে গেলে পরিবহন পারাপারে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া বাড়তি গাড়ির চাপ, ফেরির সংখ্যা কম থাকা, পণ্যবাহী পরিবহনগুলোকে পারাপারে প্রাধান্য দেয়া, গাড়ি শৃঙ্খলার নামে দুর্নীতি, টোকেন নিয়ে দুর্নীতি এসব কিছুই আগের তুলনায় কমেছে। ফলে যানবাহন পারাপারে এখন শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। তাই দুর্ভোগও কমেছে আগের চেয়ে অনেক। বিগত কয়েক বছরে এখন আর ফেরিঘাটে ঘরমুখো মানুষকে ঈদ করতে দেখা যায় না।
×