ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নৌ রেশম পথ ॥ নয়া গ্রেট গেমের পূর্বাভাস? -কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ২৯ জুন ২০১৭

নৌ রেশম পথ ॥ নয়া গ্রেট গেমের পূর্বাভাস? -কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

একবিংশ শতকের বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্তা হবে ভারত মহাসাগর-রবার্ট কাপলান চীন কি বিশ্বের জলপথ শাসন চাইছে? ভারত মহাসাগর আর দক্ষিণ চীন উপসাগর কব্জা করতেই কি বেজিংয়ের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবর) মেগা প্রকল্পের অংশ নৌ-রেশম পথ? নিজের অর্থনৈতিক ইঞ্জিনে জ্বালানির জোগান যাতে কোনও মতে ব্যাহত না হয় সেটা সুনিশ্চিত করতেই কি বেজিংয়ের সাধের এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা জোড়া ১২৪ বিলিয়ন ডলারের (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) ওবর মেগা প্রকল্প? এসব যে হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশ্ব আর্থ-রাজনীতির অলিন্দ সম্প্রতি তোলপাড় হচ্ছে তারই কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক। আলোচনা করার আগে বেজিংয়ের এ নয়া নৌ-রেশম পথ কি সেটা বোঝা যাক। মোটামুটিভাবে ওবরের যা মানচিত্র দেখা যাচ্ছে (মোটামুটি বলা হচ্ছে এই কারণে যে এই নৌ পথের কয়েকটি মানচিত্র আপাতত দেখা যাচ্ছে) তাতে এটা পরিষ্কার চীন যে জলপথে তার জ্বালানি আমদানি করে আর বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করে মূলত তার ওপর ভিত্তি করেই এই নয়া নৌ বাণিজ্য পথের নক্সা। চীনের বিশ্ব বাণিজ্যের সিংহভাগই হয় পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলোর মাধ্যমে। বিশ্বের সবচেয়ে ১০টা সমদ্র বন্দরের মধ্যে ৭টিই চীনের। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লা বন্দর কুইনহুয়াঙদাও, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কন্টেনার বন্দর সাংহাই আর বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল বন্দর কুইঙদাও। এগুলো ছাড়াও দালিয়ান, নিঙবো, গুয়াঙজাউ, ফুজৌউ,জিয়ামেন, শেনজেন, হাইকৌউ আর তাইচান বন্দর ওবর প্রকল্পের আওতায় এসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উত্তর-পশ্চিম ভারত মহাসাগর ছোঁয়া আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের মোম্বাসা, দার-এস-সালামের মতো কয়েকটি বন্দর। রয়েছে জিবুতি থেকে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা পর্যন্ত রেলপথ আর মোম্বাসা থেকে নাইরোবি পর্যন্ত ১৩.৮ বিলিয়ন ডলারের ৪৭২ কিমির পূর্ব আফ্রিকা রেললাইন করার প্রস্তাব। রয়েছে শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা, কলকাতা, চট্টগ্রাম আর মিয়ানমারের কায়ুনপুত বন্দরের সঙ্গেও। চীনের ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের (১ ট্রিলিয়ন= ১ লাখ কোটি) অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে যে তিনটি প্রধান জ্বালানি দরকার তা হলো তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস আর কয়লা। তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা হয় মূলত পশ্চিম এশিয়া থেকে। তা আসছে ১২ হাজার কিলোমিটার জলপথ পেরিয়ে পারস্য উপসাগর আর আরব সাগর পেরিয়ে উত্তর ভারত মহাসাগর ছুঁয়ে, মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে পূর্ব চীনের বন্দরগুলোতে। ওবরের নৌ-রেশম পথও কার্যত এই জলপথই অনুসরণ করছে। অন্যদিকে ইস্পাত উৎপাদনের জন্য কয়লা (নন-কোকিং কোল বা স্টিম কোল) মূলত আমদানি করা হয় অস্ট্রেলিয়া আর ইন্দোনেশিয়া থেকে। এটাও যায় দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে। ঠিক এই কারণেই পারস্য উপসাগর আর দক্ষিণ চীন সাগর এত গুরুত্বপূর্ণ বেজিংয়ের কাছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই নৌ-রেশম পথ ছকা হয়েছে। তাদের মতে, নৌ-রেশম পথের ভিত্তিই কার্যত ধরে রেখেছে চীনের তৈরি করা দক্ষিণ পাকিস্তানের বালুচিস্তানে গদর বন্দর আর দক্ষিণ চীন সাগরের প্রবেশদ্বার মালাক্কা প্রণালীতে ২০২৫ সালের মধ্যে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় বন্দর করার জন্য ৪৩ বিলিয়ন চীনা রেনমিনবি বিনিয়োগ করে মেলাকা গেটওয়ে বন্দর বানানোর পরিকল্পনা। নয়া মালাক্কা বন্দর: দক্ষিণ চীন সাগরে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে চীন দিনে গড়ে ৭২ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করেছিল। তার সিংহ ভাগই গেছে মালাক্কা প্রণালী দিয়েই। অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে সামরিক উত্তেজনাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বেজিং যদিও প্রাচীন এক মানচিত্র দেখিয়ে গোটা দক্ষিণ চীন সাগরকেই নিজের বলে দাবি করছে, কিন্তু মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স মোটেও তা মানতে রাজি নয়। বছরে বিশ্বের ৫ লাখ কোটি ডলারের এই বানিজ্যপথের সঙ্গে আমেরিকার প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তাই চীনা হুমকি ঠেকাতে মার্কিন রণতরী ঘুরছে দক্ষিণ চীন সাগরে। স্বাভাবিকভাবেই বেজিংও উঠেপড়ে লেগেছে এই এলাকায় নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে। আর তা করতে গিয়েই নজর পড়েছে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা আর মালয়েশিয়ার মধ্যে থাকা মালাক্কা প্রণালীর ওপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই জলপথ ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত এই প্রণালী দিয়ে বছরে গড়ে ৯৪ হাজার জাহাজ চলাচল করে। বিশ্ববাণিজ্যের সিকি ভাগ পণ্য চলাচল করে এই জলপথে। ২০১১ সালে দিনে গড়ে দেড় কোটি ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে গেছে। তাই মালাক্কা প্রণালীতে নয়া বন্দর গড়ার ওপর জোর দিয়েছে চীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে একদিকে যেমন দক্ষিণ চীন সাগরে নিজের বাণিজ্য তরী চলাচল রাখা সুরক্ষিত করা যাবে, তেমনি ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সামরিক উদ্দেশ্যেও পোতাশ্রয়টা ব্যবহার করা যাবে। সরকারীভাবে অবশ্য বলা হয় যে, ওবরের অংশ হিসেবে ২০১৪তে পড়শী সিঙ্গাপুরের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার জন্য মালাক্কা রাজ্য সরকারী সংস্থা কাজ ডেভলপমেন্ট আর চীনা বিদ্যুত সংস্থা পাওয়ার চীন ইন্টারন্যাশনাল মালাক্কার উপকূলের অদূরে পুলাউ মেলাকাতে গভীর সমুদ্রবন্দর করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মহম্মদ গোটা প্রকল্পটাই চীনের কাছে মালয়েশিয়ার ঋণ বাড়ানো ছাড়া আর কিছু দেখছেন না। তার মতে, ইতোমধ্যেই মালয়েশিয়ায় যথেষ্ট সংখ্যক বন্দর রয়েছে। সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার না করে নয়া বন্দর বানানো অর্থহীন। অন্যরা আবার এই প্রকল্পের মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালী কব্জা করার চীনা প্রয়াস হিসেবেও দেখছেন। তাদের মতে, ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে মালাক্কা প্রণালীতে চীনা ফৌজের নৌ, বিমান আর সেনাবাহিনীর ৬ দিনব্যাপী যৌথ মহড়া থেকেও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে বেজিংয়ের আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। আসলে মালয়েশিয়ার এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। দেশের পূর্ব উপকূলে ৫৫ বিলিয়ন ব্যয়ে চীনা সহায়তায় তৈরি হচ্ছে ইস্ট কোস্ট রেল লিঙ্ক, যা কিনা নতুন বন্দরকে মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীন বাজারের সঙ্গে যোগ করবে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পে ১৫৫ বিলিয়ন রেনমিনবি চীনা ঋণ নিচ্ছে। এতটা চীনা ঋণে জর্জরিত হওয়ায় যথেষ্ট সমালোচনার মুখেও পড়েছে মালয়েশিয়া সরকার। সরকারের যুক্তি, কি আর করা যাবে? পরিকাঠামো খাতে লগ্নি চাইতে গেলে চীন ছাড়া তো কেউ হাত উপুড় করেনি। তাই বেইজিংয়ের ওপর ভরসা করা ছাড়া আপাতত উপায় কি? অন্যদিকে এখন চীনা লগ্নি নিয়ে বেশি চেঁচামেচি করাতেও অন্য বিপদের শঙ্কা করছে মালয়েশিয়া। পারস্য উপসাগরের সামনে গদর বন্দর চীন তৈরি করছে ওবরের অংশ হিসেবে। পশ্চিম চীনের কাশগড় থেকে বালুচিস্তানের গদর বন্দর পর্যন্ত চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর হচ্ছে। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিম এশিয়া থেকে তেল গদর বন্দরে এনে সেখান থেকে করিডর দিয়ে পশ্চিম চীনে নিয়ে যাওয়ার রাস্তাও তৈরি করছে। অন্যভাবে বললে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে তেল আমদানি কমানোর পথে বেজিং। নতুন বন্দরের কাছে নিঃসন্দেহে এটা দুঃসংবাদ, কারণ যেহেতু পুরানো বন্দরের মতো এখনও পশ্চাদভূমি গড়ে ওঠেনি, তাই বন্দরে আসা জাহাজই আপাতত আয়ের প্রধান ভরসা। এই চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর বা সিপিইসি নিয়ে দিল্লীর ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। কারণ এটি ভারতের সার্বভৌমত্বের তোয়াক্কা না করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এদিকে, বঙ্গোপসাগরে চীনা নক্সা অনুসারে নৌ-রেশম পথের কাজ এগোলে সমস্যা অবশ্য আরও বাড়বে মালাক্কা প্রণালীর বন্দরের। চীনা সহায়তায় মিয়ানমারের কায়ুনপুতে গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে উঠছে। সেটা চলতি বছরের নবেম্বর মাসে চালু হলে পশ্চিম এশিয়া থেকে কেনা গ্যাস আর তেল চীনে নিয়ে যাওয়ার আরেক প্রবেশদ্বার খুলে যাবে। ইতোমধ্যেই চীনের কুনমিন থেকে কায়ুনপুত অবধি গ্যাস আর তেলের পাইপলাইন বসে গেছে। অর্থাৎ কায়ুনপুত চালু হলে গদরের মতোই এটাও মালাক্কা বন্দরের তেলবাহী ট্যাঙ্কারের ব্যবসায় থাবা বসাবে। অবশ্য শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা বন্দর নিয়ে যথেষ্ট জল ঘোলা হচ্ছে। চীনের কাছ থেকে ১৪০ কোটি ঋণ নিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রের পূর্বতন মহিন্দ্র রাজাপক্ষ সরকার ওবর প্রকল্পের আওতাধীন এই বন্দর বানায়। ঠিক ছিল পারস্য উপসাগর থেকে মালাক্কা যাওয়ার পথে এই পোতাশ্রয়ে জাহাজ ও ট্যাঙ্কার ভিড়বে। শ্রীলঙ্কা সরকারও ভেবেছিল অন্তত ১০০ কোটি ডলার আয় করা যাবে এই বন্দর থেকে। তখন বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্প বাবদ নেয়া চীন থেকে নেয়া কোটি কোটি ডলার ঋণ শোধ করা শুরু করা যাবে। কিন্তু কোথায় কি? এখন তো নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। বন্দরের কর্মীদের মাস মাইনে জোগাড় করতেই নাভিশ্বাস উঠছে সরকারের। উপান্তর না পেয়ে চীনা বন্দর নির্মাতা সংস্থাকেই বন্দরের সিংহ ভাগ শেয়ার হস্তান্তরের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রবল জনবিক্ষোভের মুখে কলম্বো পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। চেষ্টা হচ্ছে অন্য কোনও সমাধান সূত্র বার করার। কিন্তু পুরো ঘটনাটায় বেজিংয়ের মহাজনী কায়দায় ঋণজালে জড়ানোর প্রচেষ্টা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওবরের চালিকা শক্তি কিন্তু তার আগে কেন এই দুনিয়াজোড়া পরিকল্পনা, তা বোঝা দরকার। তাহলেই ওবরের আসল চালিকাশক্তি সামনে এসে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতাই মূলত বেজিংকে বাধ্য করেছে বহির্মুখী হতে। যেদিন থেকে মাও জে দংয়ের অন্তর্মুখী নীতি ঝেড়ে ফেলে গত শতাব্দীর শেষ দশকে দেং শিয়াও পিংয়ের উদারীকরণের জোয়ার এসেছে। ১০ট্রিলিয়ন অর্থনীতির বেজিং এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ওয়াশিংটনকে ছাপিয়ে যাবে বেজিং। আর বেজিংয়ের পরিকল্পনা মতো সব চললে ওবরই হতে পারে সেই ছাপিয়ে যাওয়ার মূল চালিকাশক্তি। আপাতত কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে বেজিং বেশ জেঁকেই বসেছে। কেমন সেটা? কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯০ সালে অর্থের মাপকাঠিতে বিশ্বের মোট উৎপাদনের মাত্র ৩% হতো চীনে। এখন তা বেড়ে প্রায় ২৫% হয়েছে। বিশ্বের সিংহ ভাগ বাতানুকূল যন্ত্র তৈরি হয় চীনে। দুনিয়ার ৭০ ভাগ মোবাইল ফোন তৈরি হয় চীনে। বিশ্বের ৬০% জুতা বানানো চীনা কারখানাগুলোয়। এতেই শেষ নয়। ১৯৫০ সালে বিশ্বে সাড়ে ১০ লাখ গাড়ি তৈরি হয়। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশটি গাড়ি প্রস্তুতকারী দেশগুলোর তালিকাতেই ঠাঁই পায়নি। কিন্তু সাড়ে ছয় দশক বাদে ২০১৬ সালে বিশ্বের সাড়ে ৯ কোটির গাড়ির মধ্যে প্রায় ৩ কোটি গাড়ি তৈরি হয়েছে চীনে। বলা বাহুল্য গাড়ি তৈরিতে চীন এখন বিশ্বের এক নম্বর দেশ। সোজা কথায় বিশ্বের কর্মশালা হয়ে ওঠার পথে চীন। আর বিশ্বের কর্মশালা হতে গেলে যে বিপুল জ্বালানি আর কাঁচামাল লাগে, তা তো বলাই বাহুল্য। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুত উৎপাদনেও চীন বিশ্বের এক নম্বর দেশ। ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রায় আড়াই কোটি গিগা-ওয়াট-আওয়ার বিদ্যুত উৎপাদনের মধ্যে চীন একাই ৬১ লাখ গিগা-ওয়াট-আওয়ার উৎপাদন করে। বিশ্বে এখনও সিংহভাগ বিদ্যুতই তৈরি হয় কয়লাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। চীনও এর ব্যতিক্রম নয়। ৬৫ ভাগ বিদ্যুত উৎপাদন করা হয় কয়লা পুড়িয়ে। কয়লা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন বিশ্ব কয়লা সংস্থার ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ওই বছরে বিশ্বের মোট কয়লা উৎপাদন ছিল ৮০২ কোটি টন। এর মধ্যে চীনের একারই ৩৭৫ কোটি টন (এর মধ্যে ৩১৮ কোটি টন স্টিম কোল আর ৫৭ কোটি টন কোকিং কোল)। সব বিভাগেই চীন এক নম্বর। কিন্তু এতেও চীনের কয়লার চাহিদা পুরোপুরি মিটে না। বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্ধেকই চীনা চাহিদা মিটাতে যায়। চীনা জাতীয় কয়লা সংগঠনের হিসেবে, ২০১৪ সালে চীন ২৯ কোটি টন কয়লা আমদানি করেছিল। এর ৯০ ভাগই এসেছিল সমুদ্রপথে অর্থাৎ দক্ষিন চীন সাগর দিয়ে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আরেক সোপান হলো ইস্পাত। দুনিয়ার ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন বিশ্ব ইস্পাত সংগঠন (ওয়ার্ল্ড স্টিল এ্যাসোসিয়েশন বা ডব্লিউএসএ)-র পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৬ সালে বিশ্বে মোট ইস্পাত উৎপাদন হয় ১৬৩ কোটি টন, যার মধ্যে ৮১ কোটি টন চীনের উৎপাদন। অথচ বিশ্বের চাহিদা ছিল ১৪৮ কোটি টন। অভিযোগ উঠেছে বাড়তি ইস্পাতের সিংহভাগই চীনের। কম দামে ইউরোপ আমেরিকার বাজারে বেজিংয়ের ইস্পাত ছাড়ার অভিযোগও উঠছে, যাকে পরিভাষায় বলা হয় ডাম্পিং। আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সংস্থা ফিচ রেটিংসের মতে, ২০১৫ সালের শেষে বেজিং ১১৭ কোটি টন ইস্পাত তৈরির ক্ষমতা অর্জন করেছে। ২০১৬ সালে ইস্পাত উৎপাদনের জন্য ১০২ কোটি টন লৌহ আকরিক আর প্রায় দেড় কোটি টন কোকিং কোল আমদানি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়তি ইস্পাতের উৎপাদনও চীনকে ওবর-র মতো মেগা প্রকল্প নিতে সাহস জুগিয়েছে। বেজিংয়ের হিসেব মতো ওবর-র আওতায় নির্ধারিত দেশগুলো চলে এলে শুধু বাণিজ্যবাবদই বেজিংয়ের কোষাগারে বাড়তি জমা পড়বে প্রয় আড়াই লাখ কোটি ডলার। ওবর-র ছায়ায় স্বাক্ষরিত ২৫ হাজার কোটির বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পে চীনের উৎপাদিত ইস্পাত কাজে লেগে যাবে। কিন্তু এখানেই ওবর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইউরোপের দেশগুলোর সংগঠন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউ। আর এই প্রশ্ন খোদ ইউয়ের কাছ থেকে ওঠায় নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে বেজিং। কারণ ইউ হলো চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। দিনে গড়ে ১৫০ কোটি ইউরো মূল্যের বাণিজ্য হয় দু’পক্ষের মধ্যে। সেই ইউয়ের প্রেসিডেন্ট জাঁ ক্লঁদ জানকার সম্প্রতি ব্রাসেলসে চীন-ইউ বিজনেট সামিটে পরিষ্কার জানিয়েছেন, চীনের ইস্পাত তৈরির ক্ষমতা এখন ইউয়ের দ্বিগুণ। ইস্পাতজাত কিছু পণ্যে তা চারগুণ হয়েছে। ফলে ইউয়ের ইস্পাত শিল্পকে এখন চীনা ইস্পাত ডাম্পিংয়ের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জানকার সাফ জানিয়েছেন, ওবর-র আওতায় প্রকল্পগুলোর বরাত পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে কোনওরকম বৈষম্য মানতে রাজি নয় ইউ। নৌ-রেশম পথ : গ্রেট গেমের সূচনা? নৌ-রেশম পথের পরিকল্পনা থেকে এটা স্পষ্ট, বেজিং আর নিজেকে দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে রাজি নয়। ভারত মহাসাগর দিয়ে চীনের জ্বালানি আসে। বিশ্বে চীনা পণ্য ছড়িয়ে পড়ার পথও এই জলরাশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাই বেজিং এটা ভালই জানে ভারত মহাসাগর যে নিয়ন্ত্রণ করবে, তার মুঠোয় থাকবে বিশ্ববাণিজ্যের একটা বড় অংশের চালিকাশক্তি। সেই কথা মাথায় রেখেই ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে পোতাশ্রয় বানানোর কাজে হাত দিয়েছে চীন। ওই সব দেশের অভ্যন্তরে থাকা খনিজ সম্পদ নিয়ে আসার জন্য বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য রেললাইন বসানো হচ্ছে। পারস্য উপসাগর থেকে তেল আনার জন্য শুধু মালাক্কা প্রণালীর ওপর ভরসা না করে পাকিস্তানে গদর আর মিয়ানমারে কায়ুনপুত বন্দর গড়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনের বিশ্ব অর্থনীতির দুই প্রধান শক্তি হতে চলেছে নয়াদিল্লী আর বেজিং। স্বাভাবিকভাবেই ভারত মহাসাগর নিয়েই চীনের এই উৎসাহ দিল্লীকে উদ্বিগ্ন করছে। ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো এতগুলো বন্দর নির্মাণকে বিশেষজ্ঞরা দিল্লীকে সমুদ্রপথে কোণঠাসা করার প্রয়াস হিসেবেই দেখছেন। স্বাভাবিকভাবেই নয়াদিল্লী আর তার সহযোগীরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। আর এ কথা ভুললে চলবে না, চীন তার নৌ আর বিমানবাহিনীকে ঢেলে সাজাচ্ছে। এটাকে ওবর-র সঙ্গে সময়ের কাঁটায় একই সময় হওয়াটাকে স্রেফ কাকতালীয়, এটা মানতে রাজি নয় অনেকেই। ভারতের সঙ্গে যেহেতু আর্থ-রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটা বড় অংশের স্বার্থ জড়িয়ে আছে, তাই বিশেষজ্ঞরা ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে আরেক গ্রেট গেমের পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছেন। হয়ত দ্রুত বদলাতে থাকা বিশ্ব আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা অবশম্ভাবিই ছিল। ওবর শুধু ভারত মহাসাগরে গ্রেট গেমকে ত্বরান্বিত করল। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও অধ্যাপক, ভারত
×