ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

বিএনপি ক্ষমতায় এলে কি হতে পারে?

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ২৯ জুন ২০১৭

বিএনপি ক্ষমতায় এলে কি হতে পারে?

পাঠককে এবার স্মরণ করিয়ে ও কল্পনা করতে দিতে চাই, অবশ্য এটি স্মরণ করানো আমাদের একটি জাতীয় দায়িত্ব বলেও মনে করি যে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি যোগ দিয়ে বিজয়ী হলে কি কি ধরনের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিবিরোধী এবং উন্নয়নবিরোধী অপঘটনা সংঘটিত হতে পারে। এ ঘটনাগুলো হবে তাও বলা যেতে পারে। কেননা, এই দলের নেত্রী ও তার প্রবাসী পুত্র নেতার এবং বিএনপির জন্মদাতা জিয়ার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কর্মকা-ে অবিশ্বাস্য বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে এই দলের ভবিষ্যত কর্মকা- কি হতে পারে, সেটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। বিএনপি নির্বাচনে জিতলে- ১. আরও একটি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট অথবা ২০০৪-এর ২১ আগস্ট সংঘটিত হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা তৈরি হবে। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও ৩ নবেম্বর আওয়ামী লীগের চার জাতীয় নেতার হত্যাকা- শুধু জাতির জনককে নয়, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে আইএসআইএর প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত হয়েছিল। তবে, ’৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে প্রত্যাবর্তন করার অনুমতি দেয়ার কারণে ৩০ মে জিয়াউর রহমান হত্যাকা- হয়েছিল কিনা অথবা মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের এটি নিছক ক্ষোভের ফল কিনা, সে নেপথ্য ইতিহাস কখনও উদ্ঘাটিত না হলেও বিষয়টি সম্পর্কে পাঠককে ভাবতে বলব। ২. জিয়া ’৭৫-এর পর প্রথমেই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত দালাল আইন বাতিল করে গ্রেফতার হওয়া এবং বিচারের আওতাধীন, এমন কি দ-িত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয় দালাল আইনটি বাতিল করে! উল্টো, যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজ, মান্নানদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়! স্মরণ করতে হবে, একই কাজ কিন্তু খালেদা, তারেক সংগঠিত করেছে ২০০১ সালের বিএনপিপন্থী লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের সহায়তায় ভোট কারচুপি, সোয়া লাখ ভুয়া ভোটার, হিন্দুদের ওপর চরম নির্যাতন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন, তাদের এলাকা ছাড়া করা, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন অফিসে তারেক, চার সচিব ও এক কূটনৈতিক মিলে ভোটের ফল পাল্টে দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে জয়ী হয়ে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের শিল্প ও কৃষিমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দিয়ে। তাহলে, পাঠক, এই ২০১৮’র নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হলে, আসলে বিজয়ী হবে জামায়াত-যুদ্ধাপরাধীরা এবং ফলে ট্রাইব্যুনাল তো বিলুপ্ত হবেই, অসাধারণভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চালিয়ে যাওয়া বিচারক, প্রসিকিউটর, রায় প্রদানকারী বিচারক, সাক্ষীরা, এমন কি যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবিকারী সব মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা জামায়াত-শিবির, বিএনপি, হেফাজত ও অন্য মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের হাতে আক্রান্ত হবে, যেমনটি ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে হয়েছিল। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্য, সন্তানরা অনুতপ্ত না হয়ে উল্টো খুনী পিতার, স্বামীর সমর্থক হওয়ার আইন তারা হাতে তুলে নেবে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালী, বিহারী মৌলবাদীরা হতাকা- চালাবে। ৩. নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হতে চলেছে, এমন তথ্য পেলে ওই রাতেই ঢাকা এসে পৌঁছবে তারেক, বিএনপি যার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারে বলে কখনও দেখা যায়নি। পাঠক, জনগণ তারেকের ভূমিকা, ‘জামায়াত-বিএনপি এক মায়ের গর্ভের সন্তান’ বলে তার দম্ভোক্তি, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং ২১ আগস্টের আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনাকে, আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের গ্রেনেড হামলায় হত্যার মাধ্যমে নির্মূল করার পরিকল্পক হিসেবে নিশ্চয় ভুলে যায়নি। নিশ্চয় তার স্বেচ্ছাচার, হাওয়া ভবন, খোয়ার ভবন তৈরি, মি. টেন পার্সেন্ট হয়ে ওঠা, হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রতিযোগী দক্ষ, যোগ্য নেতাদের বিএনপি-জামায়াতের জন্য মাঠকে প্রতিযোগীহীন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেখা গেছে। আহসানুল্লাহ্ মাস্টার, মমতাজউদ্দীন, শাহ্ এম এস কিবরিয়াসহ বিশ হাজারের বেশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-ছাত্রনেতা, সাংসদ হত্যাকা-ের মাধ্যমে! কোন্ দেশে এই আধুনিককালে হত্যা পরিকল্পনা করে ভিন্ন দলের রাজনীতিক হত্যা করে গ্রেফতার না হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব? কিন্তু সেটি সম্ভব হয়েছে বলে জাতি শঙ্কিত। এ তো একমাত্র জার্মানিতে হিটলারের নাজিবাদী সরকারের ইহুদী, প্রগতিশীল হত্যাকা-ের সঙ্গেই তুলনীয়! সেদেশে তো সব বড় নাজি নেতাদের ফাঁসি হয়েছে, নাজিদল নিষিদ্ধ হয়েছে। অথচ এ ব্যক্তি বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করে আওয়ামী লীগ বিরোধী চক্রান্ত পরিচালনা করেই চলেছে অব্যাহতভাবে। একবার ভাবুন, এই ঠা-া মাথার খুনী দেশে যদি ফিরতে পারে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে, তাহলে দেশে কত হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, হিন্দু, কত হাজার প্রগতিশীল ব্যক্তি, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মৌলবাদ জঙ্গীবিরোধী তরুণ, তরুণী হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যেতে পারেÑ এসব সম্ভাবনার কথাও ভাবতে হবে। জনগণকে হিসাব মেলাতে হবে- দেশের উন্নয়ন কোন্ দল করেছে এবং দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্ত স্বাধীনতা কোন্ দল রক্ষা করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ৪. বিএনপি নেত্রীপুত্র দেশে পদার্পণ করে প্রথমেই পদ্মা সেতুর সব কাজ বন্ধ করে দেবে, চুক্তি প্রত্যাহার করবে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের, বহু সেতু, ব্রিজ, বিদ্যুত কেন্দ্র, রাস্তার উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। কৃষি খাতে কৃষকের ভর্তুকি উঠে যাবে, শিল্পগুলো বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হবে, শ্রমিক চাকরি হারাবে, রফতানি হ্রাস পাবে। সমাজে যে বর্তমানে চুরি, ছিনতাই কমে গেছে, সেসব অপরাধ আবারও বৃদ্ধি পাবে। চালের উৎপাদন কমে যাবে। দাম বেড়ে যাবে। যেহেতু মহাজোট সরকার কৃষক-শ্রমিক-দরিদ্র বান্ধব, সুতরাং বর্তমানে বন্যায় সৃষ্ট চালের সঙ্কট শীঘ্রই কাটিয়ে উঠবে, কম শুল্কে চাল আমদানি করে। কিন্তু বিএনপির কখনও ধান, পাট বিষয়ে দুশ্চিন্তা নেই। কেননা, পাকিস্তানপ্রেমী দল তো সেই ’৭৬ থেকে বাংলাদেশ ধ্বংসে নিয়োজিত ছিল এবং আছে, থাকবে। ৫. স্মরণ করতে হবে, বাংলাভাই, আবদুর রহমানদের জন্মদাতা বিএনপি নেতানেত্রী শুধু যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করেনি, তারা ২০০২ থেকেই বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজ করেছে। তারা ক্ষমতা লাভ করলে নব্য জেএমবি, যারা বাংলাদেশকে শেখ হাসিনার জিরো-টলারেন্স নীতি নিয়ে সফল জঙ্গী দমন কার্যক্রম দ্বারা জঙ্গীদের প্রায় নির্মূল করে এনেছে তা বন্ধ করে দেবে এবং নতুন করে জঙ্গী উৎপাদন বৃদ্ধি করতে আশ্রয়-প্রশ্রয়- অর্থ দেবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। জনগণ তো জানেই যে, বিএনপি জামায়াতের আদর্শপন্থী একটি দল। জামায়াতের আদর্শই তাদের আদর্শ। ২০০১-০৬-এ যদি আধুনিক শিক্ষিত মির্জা ফখরুল, খোন্দকার মোশাররফ, মওদুদ আহমদ, মেজর হাফিজ আমীর খসরুরা ওই সময়ে বিএনপির তথাকথিত নেতার অপরাজনৈতিক অন্যায় অমানবিক কার্যক্রম বন্ধ করতে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে বিএনপির নতুন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব, জঙ্গী মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী অবস্থান তৈরি করতেন, তাহলে বিএনপির চরিত্র বদল হতে পারত। দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলন হতো। কিন্তু ২০১৩তে বিএনপি নেতারা নির্বাচনে আসার প্রশ্নে যখন জাতিসংঘের চেষ্টায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রায় একমত হচ্ছিলেন, তখন কেবল তারেকের একটি ‘না’ এর কাছে তারা আত্মসমর্পণ না করে যদি নিজেরা স্বাধীনভাবেও নির্বাচন করতেন, তাহলেও বিএনপি জিয়া, খালেদা, তারেকের অপরাজনীতি, হত্যা ও জঙ্গীবাদী বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করে ভিন্ন চরিত্রের বিএনপি, দেশপ্রেমিক বিএনপি গঠন করে ইতিহাস তৈরি করতে পারতেন। ইতিহাসে জাতির নেতাদের সামনে হঠাৎ কিছু ক্রান্তিকাল, মুহূর্ত আসেÑ সেই মুহূর্তে নেতাদের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বা না করার ফলে পুরো জাতি হয় বিজয়ী নতুবা জাতি পিছিয়ে পরে। বঙ্গবন্ধুর ’৭১-এ সেই ক্রান্তিকালের ডাক শুনে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী জাতি যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। এক্ষেত্রে পরে কেন এত শিক্ষিত, মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপি নেতারা বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিলেন না, তা ভেবে বড় বিস্ময় লাগে। এ সুযোগ বিএনপির সামনে বহুবার এসেছে। তাদের আহ্বান করব, আগামী নির্বাচনে খালেদা, তারেক কি সিদ্ধান্ত নেবে, তার ওপর নির্ভর না করে আপনারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন এবং দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায় নতুন একটি টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যান। দেশ ও জাতিবিধ্বংসী কার্যক্রম থেকে নিজেদের দূরে রাখুন। আর কত? দেশের ভৌগোলিক নাজুক অবস্থান, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ফল, জঙ্গী সন্ত্রাস ইত্যাদি সব দিক চিন্তা করে দেশ ও জাতিকে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উর্ধে তুলে ধরে গণতন্ত্রকে, দেশকে, জাতিকে, মুক্তিযুদ্ধকে তাদের প্রাপ্য সেবা ও স্বীকৃতি দিয়ে নিজেরা গর্বিত রাজনীতিক হোন। জনগণকে বলব, আওয়ামী লীগ কখনও মৌলবাদীদের ভোটে জেতেনি। এবার হেফাজতের সঙ্গে বোঝাপড়া করলেও স্বস্থানে ফিরে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম, প্রগতিশীল পেশাজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র- এরাই আওয়ামী লীগের ভোটার। এদের সবাইকে এবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী যুদ্ধাপরাধী মিত্রদের একযোগে প্রত্যাখ্যান করে জাতির ও দেশের উন্নয়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী মহাজোটকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করতে হবে। এ মহাজোটের সব ক্ষেত্রের সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকেই নির্বাচনে আবারও বিজয়ী করতে হবে। তাদের পরাজয়ে বাংলার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিকের পরাজয় হবে। বিএনপি বিজয়ী হলে এরা কেউ থাকবে না, এসব কিছু থাকবে না। জঙ্গী রক্তপিপাসু দৈত্যদের নিয়ে ডাকিনী ও দানবেরা এদেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করবে। মনে রাখতে হবে, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেই সবসময় আওয়ামী লীগ জিতে, কারচুপি করে জেতে বিএনপি- এটাই সত্য ইতিহাস। অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তবে আওয়ামী লীগকে লোভী, দুর্নীতিবাজ, ছদ্ম আওয়ামী লীগারদের বর্জন করে পরিচ্ছন্ন, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক প্রার্থীদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। প্রার্থী ভাল হলে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব মুক্তিযুদ্ধপন্থী দল জোট বাঁধলে অবশ্যই বিজয়ী হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×