ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এম আর আখতার মুকুলের শেষ পাণ্ডুলিপি -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ২৯ জুন ২০১৭

এম আর আখতার মুকুলের শেষ পাণ্ডুলিপি -স্বদেশ রায়

চরমপত্র শব্দটি বাংলাভাষার অনেক পুরনো শব্দ। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় হলে এই শব্দের পুরো ঠিকুজি জানাতে পারতেন। আমাদের জানার পরিধি কয়েকটি অভিধান মাত্র। তবে আজ সুনীতি চাটুজ্জ্যে থাকলে অবশ্যই তিনি চরমপত্র শব্দটির অর্থ বদল করতেন। চরমপত্রের সাধারণ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বদলে অভিধানে লেখা হতো, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান, যার লেখক ও পাঠক ছিলেন এম আর আখতার মুকুল।’ বাংলাভাষায় এখন এ ছাড়া চরমপত্রের অর্থ অন্য কিছু হতে পারে না। এম আর আখতার মুকুলকে যদি আমরা শুধু একজন বড় সাংবাদিক বলি তাহলে ভুল বলা হবে। বড় সাংবাদিক সব সময় জম্মায়। প্রতিটি প্রজন্মে থাকে। কিন্তু এম আর আখতার মুকুল বহু প্রজন্ম পরে একজন আসেন। সাংবাদিক শফিক রেহমান তখন বদলে যাননি। তিনি তখন সাঈদুর রহমানের যোগ্য সন্তান হিসেবে গণতন্ত্রের জন্যে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একজন প্রতীক হতে চলেছেন। এ সময়ে এক আড্ডায় তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটা লোকের যথার্থ মূল্যায়ন হলো না এক মাত্র কারণে, এ দেশে ‘টকার’ কাকে বলে তা কেউ চেনে না। কথা বলতে পারা যে একটি শিল্প তা এ দেশের মানুষ জানে না। এম আর আখতার মুকুল যদি ইউরোপে জন্মাতেন তাহলে তিনি একাই একটি রেডিও চালাতেন এবং তিনি সারাক্ষণ নানান বিষযে কথা বলতেন। আর লোকে তাই শুনত। জীবনের দেড় দশকের বেশি সময় এম আর আখতার মুকুল ভাইয়ের আড্ডায় কেটেছে। বাস্তবে কথা বলার আর্ট যাকে বলে, মানুষ যা শুনতে বাধ্য হবে তা সত্যি যদি কারও ভিতর দেখে থাকে তবে সেটা এম আর আখতার মুকুলের ভিতর। এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু মাত্র এখন নতুন প্রজন্মকে বলতে হবে, যদি তোমরা না শুনে থাক, তাহলে এখনই শোন। আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির এই সরকারের ব্যর্থতা হলো তার তথ্য মন্ত্রণালয় গত আট বছরের বেশি সময়ের মধ্যে গোটা সিডিটি ইউ টিউবে ছাড়তে পারল না বা সহজে সকলের কাছে পৌঁছে দিল না। একজন বড় সাংবাদিকের সব থেকে বড় গুণটি হলো তার একটি নিউজ নোজ। যার ভিতর দিয়ে তিনি সংবাদের গন্ধ পাবেন। তার পরে খুঁজে খুঁজে সেই সংবাদে তিনি পৌঁছে যাবেন। এই নাকটি সর্বোচ্চ ছিল এম আর আখতার মুকুলের, যা বিস্ময়কর এক নাক। চরমপত্রে তিনি যুদ্ধের প্রয়োজনে কিছু অতিরঞ্জিত করেছেন মাঝে মাঝে তবে সব কিছুই কিন্তু খবর নির্ভর ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে ওই সময়ে যে বিশ্ব নন্দিত মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ঘটে-তিনি টাইগার সিদ্দিকী বা বাঘা সিদ্দিকী। এই নামটি এম আর আখতার মুকুলেরই দেয়া। তাঁর চরমপত্রের মাধ্যমে কাদের সিদ্দিকী বাঘা সিদ্দিকী বা টাইগার সিদ্দিকী হিসেবে বিশ্ববুকে পরিচিত হন। কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জন্যে এক মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। এই কাদের সিদ্দিকীকে টাইগারে অভিহিত করেন এম আর আখতার মুকুল। ইয়াহিয়ার মন্ত্রী মালেককে ঠ্যাটা মালেক্কা নামেই তিনিই পরিচিত করে দেন। আসলে চরমপত্র নিয়ে লিখতে গেলে আবার আরেকটি বই লিখতে হয়। এ লেখা বাস্তবে গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজার জন্যে। অর্থাৎ ২৬ জুন ছিল মুকুল ভাইয়ের মৃত্যু দিন। তাঁকে স্মরণ করার জন্যে তাঁর জীবন ও কর্মের কিছু তথ্য মনে করা মাত্র। তাছাড়া তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর মতো ব্যক্তি আমি নই। তিনি ইতিহাসের ও সাংবাদিকতার যে রাজপাটে বসে আছেন সেখানে উঠে প্রণাম করার মতো দীর্ঘ শরীর আমি আমার কাজ দিয়ে এখনও তৈরি করতে পারিনি। তবে তার পরেও তাঁর যে স্নেহ এ জীবনে পেয়েছি, যে উপদেশ পেয়েছি তাতে দুর্বল কলম ও ক্ষীণযোগ্যতা দিয়ে হলেও তাঁর মৃত্যুদিন উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করা। তবে তাঁর স্নেহই আমাকে বাধ্য করে প্রতিদিন তাঁকে স্মরণ করতে। এম আর আখতার মুকুলের নিউজ নজের কথা উল্লেখ করেছি একটু আগেই। ছোট্ট একটি ঘটনা, আমরা অনেকই বসে ও দাঁড়িয়ে সাগর পাবলিশার্সে তার কথা শুনছি। এমন সময় আমাদের সকলের স্নেহভাজন গুণী অভিনেত্রী আফসানা মিমি ঢুকেছে সেখানে। মিমি সব দিন অনেক বই পড়ে। প্রায়ই সে বই কেনে। তাই তার এখানে আসার ভিতর আমরা নতুন কিছু লক্ষ্য করেনি। মিমি সবাইকে সালাম দিয়ে কিছু বই কিনে নিয়ে চলে যায়। মিমি বের হতেই মুকুল ভাই একটা ছেলেকে ডেকে বলেন, এই দেখত নাটক পাড়ায় মিমিকে নিয়ে কিছু হয়েছে কিনা? তখনও আমরা মুকুলভাইয়ের কথায় অত গুরুত্ব দেইনি। আমরা আড্ডায় মেতে আছি। কিছুক্ষণ পরে ওই ছেলেটি ফিরে এসে বলে, রক্তকরবীর নন্দিনী হিসেবে আজ থেকে অভিনয় করছে অপি করিম, মিমি বাদ পড়েছে। মুকুল ভাই বললেন, তাইত আজ ওর মুখে কোথায় যেন একটা ছায়া দেখতে পেলাম। আমারও সাংবাদিকতার বয়স তখন একেবারে কম নয় অর্থাৎ আর যাই হোক নবিস নই। কিন্তু বুঝলাম এম আর আখতার মুকুলের সামনে এখনও আমি নবিসই আছি। কই, সাংবাদিক হিসেবে আমার চোখে তো তা পড়েনি। মুকুল ভাই অবশ্য বলতেন, দেখ আমি চরমপত্র করা লোক। আমি গন্ধ হুঁকেই বলতে পারি, কী ঘটবার লাগছে। বিএনপি আমলের তথ্যমন্ত্রী শামসুল ইসলাম তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। বিশেষ বন্ধু ছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী। একদিন দুজনই এক সঙ্গে বই কিনতে ঢুকেছেন। ইসলাম ভাই বিএনপি করলেও এখনকার বিএনপির মতো নয়, তিনি সবার সঙ্গে মিশতেন, পড়াশোনার বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। নতুন কোন বইয়ের খোঁজ আছে কিনা আমাকে ফোন করে খবর নিতেন। আর বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্কটি অনেকখানি পারিবারিকে গিয়ে দাঁড়ায়। যা হোক সেদিন তাঁরা দুজন আসাতে আড্ডা বেশ মেতে উঠেছে। এর ভিতর এক পর্যায়ে শামসুল ইসলাম ভাই বললেন, আরে আপনারা রাজাকার বলেন সবুর খানকে- কিন্তু তাকেই তো আপনাদের জয়বাংলার পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে সম্মান জানানো হয়েছে জানাযার আগে। মুকুল ভাই এক সেকেন্ডের কয়েক ফ্রাকশান সময় না নিয়েই বললেন, আরে, এ অবস্থা হবে বলেই তো আমরা আগেই জয়বাংলার পতাকা জাদুঘরে রেখে দিয়েছি। দেশ স্বাধীনের পর আলাদা পতাকা বানিয়েছি। জয়বাংলার পতাকা রাজাকাররা পায়নি। আজ কেন যেন লিখতে বসে মনে হচ্ছে, এখন মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেলে আমরা পতাকা মুড়িয়ে সম্মান দেই, ওই পতাকা আমাদের একাত্তরের পতাকাটাই হওয়া উচিত। মুকুলভাই দুরারোগ্য ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু অচেতন হওয়ার আগ অবধি কখনই তাঁর প্রাণচাঞ্চল্যের কমতি দেখিনি। জীবনের শেষ কয়েকদিন তিনি আর সাগর পাবলিশার্সে যেতেন না। তাই দিনে অন্তত একবার হলেও বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসতাম। সে সময়ে তিনি তাঁর জীবনের শেষ কাজটিতে হাত দিয়েছেন। তিনি তখন ’৭১-এর নয় মাসের ও বাংলাদেশ হওয়ার পরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে যাওয়ার জন্যে একটা বই লিখছেন। বইটির বড় অংশ জুড়ে যেহেতু তাজউদ্দীন আহমদ, তাই তিনি বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘দুর্দিনের প্রধানমন্ত্রী’। এই পা-ুলিপিটি কেন হারিয়ে গেল তা আমার কাছে সব সময়ই রহস্যজনক মনে হয়। প্রতিদিনই তিনি তাঁর ওই লেখার কিছু অংশ হয় টেলিফোনে না হয় সামনাসামনি বসে পড়ে শোনাতেন। তাঁর ওই পা-ুলিপিতেই তিনি লিখেছিলেন, কিভাবে এনায়েতুল্লাহ খান সিক্সটি মিলিয়ন কলাবরেটর লিখলেন। এম আর আখতার মুকুল ওই সময়ে ইনফরমেশন মিনিস্ট্রির ডিজি। ডিজি হিসেবে তিনি পাকিস্তান রেডিওতে ও টেলিভিশনে যে সব শিল্পী নয় মাস কাজ করেছেন, তাদের রেডিও এবং টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করেছেন। সাংবাদিক এ বি এম মূসা তখন টেলিভিশনের ডিজির দায়িত্ব নিয়েছেন। ডিজির দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি ওই নিষিদ্ধ শিল্পীদের টেলিভিশনে সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এম আর আখতার মুকুলকে বার বার অনুরোধ করেন, ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য। এম আর আখতার মুকুল নারাজ। তাই এবিএম মূসা তখন এনায়েতুল্লাহ খান ও আরেকজন সাংবাদিককে ডেকে গোপনে বলেন, দেখ আমি তো এদের কাজ করাতে পারছি না। এম আর আখতার মুকুলও চরমপত্র করে এমন অবস্থানে চলে গেছে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলাও মুশকিল। তাছাড়া এরা পাকিস্তানীদের হয়ে কাজও করেছে। তাই তোমরা বরং একটা বিতর্ক সৃষ্টি কর। লিখে দেও যে ছয় কোটি মুজিবনগরে যায়নি তারা সবাই কি কলাবরেটর। আর এভাবেই লেখা হয় ওই লেখা, ওটাই ছিলো বাংলাদেশে প্রথম রাজাকারদের একটি স্থান দেয়ার লেখা, ‘সিক্সটি মিলিয়ন কলাবরেটর’। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করার কাজ করেছেন তাদের সবার কীর্তিকলাপ লেখা ছিল ওই পা-ুলিপিতে। বড়ই প্রয়োজনীয় এ পাণ্ডুলিপিটি আমাদের ইতিহাসের জন্যে। কোন উপায় কি নেই এ পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করার। এ পা-ুলিপিটি উদ্ধার করে বই আকারে প্রকাশ করলে আমরা আরেকটি চরমপত্র পেতাম। আর যদি না পাই তাহলে আমাদের ইতিহাসে অন্তত একটি লাইন লিখতে হবে-এম আর আখতার মুকুলের আরেকটি চরমপত্র হারিয়ে গেছে। [email protected]
×