ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যন্ত্রণামধুর ঈদযাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৫ জুন ২০১৭

যন্ত্রণামধুর ঈদযাত্রা

বাড়ি যাই, গ্রামের বাড়ি, সেখানে বড় সুখ। সেখানে গাছের পাতা বুকের মতো বড়। মায়ের আদর, পিতার স্নেহ, স্বজনের শুভাশীষ বড়ই বেশি মধুর হয়ে টানে। নাড়ির টান, শেকড়ের টান নিয়ে যায় প্রিয় ভূমিতে, বসতবাড়িতে। হৃদয়জুড়ে আনন্দ আর আবেগের সংমিশ্রণে এক অভূতপূর্ব উচ্ছ্বাস জাগে। নতুন পোশাক, বাহারি খাবার আর আলিঙ্গন ও কোলাকুলির মাধুর্যে প্রাণে প্রাণে আনে স্বর্গীয় আবহ। শ্রেণী ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার এই লগ্নগুলো স্বল্পস্থায়ী হলেও তার রেশ থেকে যায় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ছাপিয়ে মিলনের সুর বেজে ওঠে। পবিত্র এক আবেদন চরাচরে জেগে থাকে। এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ ধ্বনি শোনা যায় সর্বত্র। কিন্তু আনন্দের অপর পিঠে দুর্ভোগ যন্ত্রণা আর ভোগান্তির যে চিত্র তাতে ম্লান হয়ে আসে অনেকের উৎসবে মাতোয়ারা হবার ক্ষণ। এর থেকে বুঝি পরিত্রাণ নেই! দুশ্চিন্তা মুক্ত, দুর্ভোগহীন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরার যে আকুতি, তা বুঝি আর কখনও মিলবে না এই বাংলাদেশের বাঙালী মুসলমানের জীবনে। কত শত আশ্বাস বাণী শোনায় দ-মু-ের কর্তারা, সেসব বাতাসে মিলিয়ে যায়, বাস্তবতার ধারে কাছে ঘেঁষে না। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ প্রবাদের হাত ধরে ঈদ উদ্যাপনে বাড়ি ফেরা, সে এক মহাধকল, মহাদুর্ভোগ। তার ওপর রয়েছে হরেক রকম হয়রানি, চাঁদাবাজি, নজরানার উপদ্রব। সব মিলিয়ে সে এক বিতিকিচ্ছি ব্যাপার এই ঈদযাত্রায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু নয়, দিনমান যানজটে আটকা পড়ে দুশ্চিন্তাকে স্কন্ধে তুলে মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতীক্ষার প্রহর গোনায় নেই কোন আনন্দ, নেই সুখপ্রদ ভাললাগা। বিরক্তিকর, কষ্টদায়ক এই সময়গুলোতে মানুষ হয়ত অভিশাপ দেয়, নিন্দামন্দ বাক্য নির্গলিত হয় তাদের হৃদয়মথিত ক্রন্দনাকুল বক্ষ হতে। কিন্তু সেসব কর্তাব্যক্তিদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। তারা প্রাচীন আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে নির্বিকারভাবে, নিরাপদে বাড়ি ফেরার সব আয়োজন রাখা হয়েছে। এসব ছেঁদো কথার সঙ্গে বাস্তবের সঙ্গতি কস্মিনকালেও মেলে না। ভাঙ্গাচোরা, খানাখন্দে ভরা সড়ক, মহাসড়কগুলো মৃত্যুকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই প্রতিবছর ঈদে ঘরমুখো কত শত মানুষ যে পৃথিবী থেকে স্বজন থেকে, ঈদের আনন্দ ফেলে চলে যায় পরপারে তার হিসেব নেই। দুর্ঘটনার কবল থেকে কেউ বুঝি পারে না তাদের রক্ষা করতে। তাদের স্বজনদের জীবনে তাই ঈদ আনন্দ নয়, আসে বিভীষিকা নিয়ে। প্রতিবছর ঈদের কদিন আগে সড়ক মেরামতের নামে চলে অর্থের অপচয়। সংস্কারহীন রেললাইন আর রেলবগির মেরামত কাজ মহাসমুদ্রে এক ফোঁটা জলের মতোই, কোন কাজে আসে না। আর বিমান যাত্রা, সে তো মুষ্টিমেয় জনের জন্য। কিন্তু বহরে বিমান নামমাত্র। তাও আবার অভ্যন্তরীণ সিডিউল ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে বেসরকারী বিমানগুলোর যাত্রী বহনের সুযোগ বেড়েছে। নৌপথের অবস্থাও ভয়াবহ। আবহাওয়ার পরিস্থিতি না জেনে লঞ্চ, স্টিমারগুলো বহনের অধিক যাত্রী বোঝাই করে ঘাট ছেড়ে যায়, তখন যাত্রীরা যেন জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য মেনে বাড়ি ফেরার স্বপ্নে মগ্ন হয়ে পড়ে। কী বিপজ্জনক এই যাত্রা! তারা ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারে না। যে কোনভাবেই বাড়ি ফেরার এই উদগ্র বাসনা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। রেলের ছাদে, দরজার হ্যান্ডেল ধরে মৃত্যুর ভয়াবহতা মেনে নিয়ে এই যে ছুটে চলা নিজ বাসভূমে, যেন এক রণাঙ্গনে মহাযুদ্ধে লিপ্ত সৈনিক তারা। এই যে বাস, ট্রেন, লঞ্চে উপচেপড়া যাত্রীদের ঠাঁই নিতে হয়, তার জন্য মাশুল গুনতে হয় চড়াদামে ভাড়ার। যাত্রীরা জিম্মি হয়ে যায় এসব পরিবহন ব্যবস্থাপকদের হাতে। রাষ্ট্র বা সরকার এসব দুর্ভোগ লাঘবে বাস্তবসম্মত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিয়েছে, এমনটা দূর অতীতেও যেমন শোনা যায়নি, নিকটকালেও নয়। আনন্দ উদ্যাপনের আগে দুর্ভোগকে বরণ করে নিলে, যন্ত্রণাময় যাত্রাকে সঙ্গী করা হলে বুঝি আনন্দের মাত্রা অত্যধিক হয়। ভোগান্তি পোহায়ে তবে আনন্দের পথযাত্রায় মানুষের ঘরমুখো হবার প্রবণতা দীর্ঘকালের। কিন্তু কোন মহামানব আসে না এই ক্লান্তিকর, বিপজ্জনক, মৃত্যুমুখী যাত্রা থেকে নিবৃত্ত করার উপকরণ নিয়ে। লৌকিকভাবে হয়ত এর সমাধান হবে না। বরং অলৌকিকভাবে যদি কিছু হয়- সেই ভরসায় থাকতে হয় যন্ত্রণামধুর গ্লানিময়, অপচয়মুখী ঈদযাত্রার সময়। স্বস্তির ঈদ ভ্রমণ তাই নৈবচ নৈবচ।
×