ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীন আগ্রহী কারণ নির্ণয়ে গবেষণা ও পুনর্বাসনে

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৫ জুন ২০১৭

চীন আগ্রহী কারণ নির্ণয়ে গবেষণা ও পুনর্বাসনে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে সাম্প্রতিক নজিরবিহীন পাহাড় ধসসহ সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির কারণ নির্ণয় ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে চীন গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে চীনের পক্ষে সে দেশের সরকারী সংস্থা চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের (সিএএস) আওতাধীন ভূতাত্বিকবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেন হেজার্ড এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (আইএমএইচই) পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করে পত্র দিয়েছে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতির কথা বলেছে। এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সার্বিক বিষয়টি অবহিতকরণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ইতোমধ্যে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া নেপালের কাঠমান্ডভিত্তিক সমন্বিত পর্বত উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিআইএমওডি (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনটিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট) ও এ বিষয়ে কাজ করার জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা শনিবার জনকণ্ঠকে সার্বিক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমতি পেলেই এসব সংস্থা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পৃথক পৃথক টিম বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ আইসিআআইএমওডির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ১৯৮৪ সালে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, ভারত, চীন ও মিয়ানমার নিয়ে এ সংস্থাটি গঠিত হয়েছে। গেল বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে বাংলাদেশের পক্ষে সংস্থার বোর্ড অব গবর্নেসের দায়িত্ব পালন করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। বর্তমানে এ পদের দায়িত্ব রয়েছে ভুটান। বাংলাদেশের ইতিহাসে পাহাড়ের তিন জেলায় একযোগে একই সময়ে ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের ঘটনা ও বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং সহায় সম্পদের ক্ষতির সংবাদ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার পর আইএমএইচসি ও আইসিএমওডির পক্ষে শোক জ্ঞাপনের পাশাপাশি তাদের পক্ষ থেকে গবেষণা বিষয়ে করণীয় ও সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়। এ কার্যক্রমে সরকারের কাছ থেকে কোন অর্থ নেবে না বলে তারা জানিয়েছে। শুধু আবাসন ব্যবস্থা, যাতায়াত সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম পার্বত্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা বিষয়টি আমলে নিয়ে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করেছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, এ কাজে বিপুল অঙ্কের যে অর্থ ব্যয় হবে তা চীন ও নেপালভিত্তিক ওই সংস্থার পক্ষে বহন করা হবে বলে জানানো হয়। তাদের পক্ষে ভূমিধসের কারণ নির্ণয় ছাড়াও এ ধরনের ধস রোধে করণীয় নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক রিপোর্ট প্রদান করা হবে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনেও তৎপরতা চালানো হবে। সার্বিক বিষয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হবে চীন সরকারের। সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে বর্তমানে উচ্চমাত্রার বন্ধুত্বপূর্ণ যে সম্পর্ক রয়েছে এ প্রস্তাব তারই বহিঃপ্রকাশ। তারা আশা করছেন, সরকার নীতিগতভাবে এ প্রস্তাবের অনুমোদন দিলে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কাজটি তরান্বিত হবে। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে পাহাড়ের ধস থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকভিত্তিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। রাঙ্গামাটি থেকে জনকণ্ঠের নিজস্ব প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী জানান, পাহাড় ধস এবং পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপের শহর রাঙ্গামাটির লক্ষাধিক লোকের এবারের ঈদ আনন্দ শোকে ম্লান হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগে পাহাড় ধসের ঘটনার পর স্বজনহারা এবং সহায় সম্পদহীন মানুষের মাঝে ঈদের যে আনন্দ তার লেশমাত্র নেই। ক্ষতিগ্রস্তরা এখন নিজেদের পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার তৎপরতায় লিপ্ত। সেনাবাহিনীর ত্বরিৎ কার্যক্রম গ্রহণের ফলে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানের অচলাবস্থার অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। গত ১৩ জুন আকস্মিক রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় অত্যন্ত ভারি বৃষ্টি ও বজ্রপাতে রাঙ্গামাটি শহরে ব্যাপক আকারে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড় ধসে শুধু রাঙ্গামাটিতে ১২০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে শুধু শহরের ভেদভেদী এলাকায় ৫০ জনের অধিক পাহাড় ধসে মারা গেছে। এ ঘটনার বিদ্যুত পানি ও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ৪ দিন ধরে রাঙ্গামাটি শহর ভুতুড়ে নগরী ছিল। নয় দিনের মাথায় গত বুধবার দুপুরের পর সাপছড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে বিকল্প সড়ক তৈরি করে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। এ সড়ক খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটির সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানের সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। সড়কটি টেকসই না হওয়ার ফলে সড়ক বিভাগ সেখানে ১৬০ ফুট দীর্ঘ বেইলি ব্রিজ স্থাপনের প্রাথমিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় রাঙ্গামাটিতে উৎপাদিত মৌসুমি ফল টার্মিনাল, ঘাট ও বাগানে পচে কয়েক কোটি টাকার পণ্য পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া গত ১২দিন ধরে ভারী যানবাহন রাঙ্গামাটি শহরে আসা-যাওয়া করতে না পারায় পরিবহনের অভাবে গাছ, বাঁশ থেকে শুরু করে সকল ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য স্থবির হয়েছে পড়েছে। যার ফলে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় সঙ্কট নেমে এসেছে। সামগ্রিকভাবে এ দুরাবস্থার পর এ শহরে ঈদ উদযাপনের যে আনন্দ থাকে সে পরিবেশ আর নেই। স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ফলে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের সংখ্যা ৩ হাজারের অধিক হযেছে। এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে নতুন করে ঘর না করার নির্দেশ দেয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও আরও কয়েক হাজার লোক তাদের ভিটামাটিতে যেতে পারছে না। শুধু রাঙ্গামাটি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ১৮ হাজারের অধিক। রাঙ্গামাটি শহরের প্রধান তিনটি বাজার রির্জাভবাজার, তবলছড়ি ও বনরূপা বাজারের মার্কেটগুলো শবেই কদরের পর ফাঁকা হয়ে আছে। অথচ মার্কেটগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এখনও অনেক দোকান-পাট বন্ধ রয়েছে। আর যেগুলো খুলেছে সেগুলোতে ক্রেতা বলতে একেবারে যৎসামান্য। অপরদিকে, গত ১৩ জুনের ভূমিধসের ঘটনার পর পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সড়ক বন্ধ ছিল। বিজিবি সদস্যরা এককভাবে এ সড়কের ১৫টি পয়েন্টে পাহাড়ের ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করলে শুক্রবার থেকে হালকা যানবাহনের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। এ সড়কটি এলজিইডির নিয়ন্ত্রণে হলেও ধসের ঘটনার পর বিজিবি সদস্যরা দিবারাত্রি পরিশ্রম করেছে সচল করার জন্য। ভেঙ্গে পড়া বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছপালা ও তার সঙ্গে পাহাড়ী মাটির ধ্বংসস্তূপ করিয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। বান্দরবান থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগের পর রাঙ্গামাটি-রুমা এবং বান্দরবান-রুমা সড়ক এখনও সচল করা যায়নি। তবে সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শুক্রবার থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস ও সেতু বিধ্বস্ত হয়েছে। বান্দরবান-রুমা সড়কের ২২ কিলোমিটার এলাকায় পাহাড় ধসের কারণে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিধ্বস্ত রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়কের ১৬ কিলোমিটার অর্থাৎ বরইছড়ি থেকে ঘাগড়া পর্যন্ত জন ও হালকা যানবাহন চলাচল শুরু হওয়ায় এ এলাকার জনজীবনে আরও একধাপ উন্নতি হয়েছে।
×