ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৬ চৈত্র ১৪৩০

গোয়েন্দাদের দৃষ্টি ‘ভোরের ছিনতাই পার্টি’র দিকে!

এএসপি মিজান হত্যার মোটিভ মেলেনি, মাঠে ডিবির ৬ টিম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৫ জুন ২০১৭

 এএসপি মিজান হত্যার মোটিভ মেলেনি, মাঠে ডিবির ৬ টিম

শংকর কুমার দে ॥ হাইওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মিজানুর রহমান তালুকদারের মোবাইল ফোন নেয়নি ঘাতকরা। কিন্তু মানিব্যাগ নিয়ে গেছে। ওয়াকিটকিরও খোঁজ পাচ্ছেন না তদন্তকারীরা। খুনের মোটিভ এখনও অনুদঘাটিত। খুনের তিন দিন পরও খুনীরা গ্রেফতার হয়নি। খুনের ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখনও খুনের ঘটনা রহস্যাবৃত্তে ঢাকা। খুনের রহস্য উদঘাটনে ছয়টি টিম গঠন করা হয়েছে। একযোগে তদন্ত করে যাচ্ছে তদন্ত সংস্থা ডিবির সঙ্গে ছয় টিম। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হত্যাকা-ের তিন দিন পরও এএসপি মিজানুর রহমান হত্যাকা-ের ঘটনায় বিশেষ কোন ক্লু খুঁজে পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা। তিনি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ও হত্যাকা-ের ধরন বিবেচনা করেই মূলত হত্যাকা-ের প্রাথমিক মোটিভ হিসেবে ‘ছিনতাইকারী’, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টির কাজ বলে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন কর্মকর্তারা। কারণ ঈদ সামনে রেখে ভোরের দিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িযোগে ছিনতাইয়ে নামে একাধিক গ্রুপ। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বাইরের বিভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রুপ ঈদ উপলক্ষে নিজ এলাকার বিভিন্ন মানুষকে টার্গেট করে। এজন্য নিজেরাই যাত্রীবেশে গাড়িতে অবস্থান করে যাত্রীর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে গাড়িতে তোলে। এরপর সুবিধাজনক সময়ে সবকিছু কেড়ে নিয়ে ছিনতাইকারীরা তাকে খুন করে নিরাপদ জায়গায় ফেলে রেখে যায়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক তদন্ত কর্মকর্তা নাম- পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঈদ উপলক্ষে রাস্তার যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্যই এএসপি মিজানুর রহমান ভোর বেলায় উত্তরার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তার সম্ভাব্য গন্তব্য ছিল কালিয়াকৈরের অফিস। কাজেই সেই পথ ছাড়াও সাভারের একাধিক রুটের ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি পেশাদার অপরাধ চক্রের সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া পেশাদার খুনী ও পেশাদার ডাকাত দল নিয়ে কাজ করেন এমন গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও এএসপি মিজান হত্যাকা-ে জড়িতদের গ্রেফতার করতে বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করে এগোচ্ছেন। তদন্তের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতীয়মান হচ্ছে খুনী একাধিক। হত্যার আগে এএসপি মিজানকে শক্ত কিছু দিয়ে মারধর করা হয়েছে। ওইসময় তার পরিচয় কোনভাবে প্রকাশ হওয়ার কারণেই তাকে হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা করতে চেয়েছিল খুনীরা। তাদের রেখে যাওয়া ঝুট কাপড়ই আসামিদের একমাত্র আলামত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই কাপড় দিয়েই এএসপি মিজানের গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এ কারণে ওই কাপড়ের টুকরার ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নিহত পুলিশ কর্মকর্তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন, পোশাক ও রক্তের নমুনার পরীক্ষার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এএসপি মিজানুর রহমান তালুকদার হত্যাকা-ের মোটিভ ও রহস্য উদঘাটনে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবিসহ ছয়টি টিমের কর্মকর্তারা একযোগে কাজ করছে। রূপনগর থানা পুলিশের কাছ থেকে গত শুক্রবার দুপুরের মধ্যে মামলার ডকেট ও যাবতীয় তথ্যাদি বুঝে নিয়েছেন মহানগর ডিবি মামলার তদারকি করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এখন পর্যন্ত হত্যার নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে যথাসময়েই জড়িতদের শনাক্ত করা যাবে। আর হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে পারলেই হত্যাকা-ের আসল মোটিভ বের হয়ে আসবে। পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক মিজান হত্যার পরেরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপি গুলশানের পুলিশ প্লাজা মার্কেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, কারা, কেন এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে তা তদন্ত শেষে বলা যাবে। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া মিজান হত্যা মামলাটি তদন্তের ভার ডিবির কাছে ন্যস্ত করে দ্রুত হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য ছয়টি টিম করে দিয়েছেন। এডিসি এডিসি গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন কারণের পাশাপাশি আমরা যাত্রীবেশী ছিনতাই চক্রের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। পারিপার্শিক অবস্থা ও খুনের ধরন দেখে মনে হয়েছে ভোরের ছিনতাই পার্টি এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত লেগুনা টাইপের গাড়িতে যাত্রীবেশে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা বসে থাকে। সম্ভবত এ ধরনের চক্রের হাতেই পড়েছিলেন এএসপি মিজানুর রহমান। পরবর্তীতে ওই চক্রের লোকজন তার পরিচয় জানার পরপরই তাৎক্ষণিক হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই মোতাবেক শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ মিরপুর বেড়িবাঁধের ঢালে ঘন জঙ্গলে ফেলে পালিয়ে যায়। হত্যার মোটিভ ও লাশ ফেলে রাখার সূত্র ধরে পুলিশ ও গোয়েন্দারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, এই খুনের সঙ্গে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি জাড়িত। রাজধানীর উত্তরা, আবদুল্লাহপুর ও টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকার এসব যাত্রীবেশী ছিনতাই চক্রের সদস্যদের ধরতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে। ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, একমাত্র এএসপি মিজান হত্যাকা- ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় গোটা রমজান মাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ছিল চমক সৃষ্টির মতো। রমজান মাসে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ছিনতাই, ডাকাতি, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টিসহ নানা ধরনের অপরাধ দমন করা হয়েছে শক্ত হাতে। এএসপি মিজান হত্যাকা-ের ঘটনার ঘাতকদের চিহ্নিত করার মাধ্যমে গ্রেফতার করে হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দা সংস্থা ডিবিসহ ছয় টিম তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রসঙ্গত বুধবার রাজধানীর রূপনগর থানার মিরপুর বেড়িবাঁধের বোটক্লাব এলাকার রাস্তার পাশে ঝোপঝাড় থেকে এএসপি মিজানুর রহমান তালুকদারের (৫০) লাশ উদ্ধার করা হয়। বুধবার রাতেই এএসপি মিজানের ভাই মাসুম তালুকদার বাদী হয়ে রূপনগর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মাজহারুল হক আগামী ৩০ জুলাই এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, এএসপি মিজানের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার গলার চারপাশে একটা গোল কালো দাগ ছিল। মাথায়, বাঁ হাতে ও দুই পায়ে লাঠি বা শক্ত কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। দুই গাল ও বুকের উপরের অংশে আঘাতের চিহ্ন ছিল। যেসব জায়গায় আঘাত করা হয়েছে, সেখানে রক্ত জমে গিয়েছিল। এরপর থেকে সহজ-সরল ও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা এই পুলিশ কর্মকর্তাকে কী কারণে কারা হত্যা করেছে, তার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত করছে ছয়টি টিমসহ পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
×