এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ ঈদ-উল ফিতর যতই ঘনিয়ে আসছে-ততই স্বজনহারা পরিবারে কান্নার রোল বেড়েই চলছে মহেশখালীতে। অবুঝ শিশুরা ঈদের কাপড় বা নতুন জামা নিয়ে তাদের পিতা কখন আসবে? এ কথা মাকে জিজ্ঞেস করলে স্বামীহারা স্ত্রীদের কেউ কেউ শিশুদের উত্তর দিতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ তাদের শিশুদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলছে-তোদের বাবা নতুন জামাকাপড় নিয়ে আসবে।
গত ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরার কবলে পড়ে কক্সবাজারের উপকুলীয় দ্বীপ মহেশখালীর ৫টি ফিশিং ট্রলারের নিখোঁজ ৫৩ জন মাঝি–মাল্লা নিখোঁজ রয়েছে। এদিকে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওই নিখোঁজ প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ৫ হাজার টাকা ও ২০ কেজি করে চাউল বিতরণ করা হয়েছে।
শনিবার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ হল রুমে নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আবুল কালামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ত্রাণ বিতরণ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক এমপি। প্রধাণ অতিথি বলেন, সরকারের তরফ থেকে নিখোঁজ প্রত্যেক পরিবারকে পুনর্বাসন করতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে এবং নিখোঁজ জেলেদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব তিনি তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে চালিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। নিখোজ মাঝি–মাল্লারা হলেন, মনিরুল কাদের, জামাল হোসেন, আমান উলাহ মাঝি, মিজানুর রহমান, শহীদুলাহ, আরাফাত, নজরুল ইসলাম, এহেছান উলাহ, মীর কাশেম মেইঠ্যা, সারজান, মনিরুল হক মলই, আলতাজ মিয়া, আব্দুল করিম, খলিল আহাম্মদ, মোক্তার আহাম্মদ, লোকমান, সোহেল, বদি আলম, এমরান, আমানুল করিম, জাবের, মামুন, মোহাম্মদ জহির, আবু ছিদ্দিক, এবাদুল করিম, গফুর বাবুর্চি, মনিরুলাহ মনি, ইছাহাক মিয়া, মোস্তাক আহাম্মদ চুইণ্যা, আনচার ড্রাইভার, গোলাম হোসেন, মো. হোছেন কালইয়া মাঝি, বেলাল হোসেন, নূর মোহাম্মদ, শাহাব উদ্দিন, নেছার মাঝি, আবু হামিদ, আজাদ ড্রাইভার, শামসুল আলম, সৈয়দ উলাহ, জাবেদ উলাহ, ফজল করিম, মমতাজ বাবুর্চি, ইয়াছিন, নুরুল হোসেন, মো. হোছন মাঝি, শাহাব মিয়া, খাইরুল আমিন, আব্দুল মোতালেব ও নুরুল আবছার।
ঘূর্ণিঝড় মোরার ছোবলে পড়ে ৫টি ট্রলারের ৫৩জন জেলের হদিস মেলেনি এখনও। ২৬দিন ধরে মৃত বা জীবিত স্বজনকে না পেয়ে ওসব জেলে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ঈদ উপলক্ষ্যে বাবা-ভাই আসছে কিনা তা দেখতে কিশোর-কিশোরীরা দরজা খোলা রেখে পথ চেয়ে বসে থাকে। ঘূর্ণিঝড় শুরুর অন্তত ৫-৬দিন আগে পুটিবিলা এলাকার স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর আব্দু শুক্কুরের মালিকানাধীন এফবি সায়েদ, এফবি ওয়ালিদ-১, এফবি ওয়ালিদ-২, ও একই এলাকার নুরুল আলম প্রকাশ বাঁশি মাঝির মালিকানাধীন এফবি গাউছিয়া নামের ৪টি ফিশিং ট্রলারে করে ৮৬ জন মাঝি মাল্লা সাগরে মাছ ধরতে যায়। ২৯মে ঘূর্ণিঝড় মোরার ছোবলে পড়ে বঙ্গোপসাগরে ৫টি ফিশিং ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। জেলেরা সাগরে ভাসমান ও সাঁতার কেটে যে যেদিকে পারে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা চালায়। ১ জুন ভারত থেকে বাংলাদেশে ত্রাণবাহী নৌ-জাহাজ সুমিত্রা ৩৩ জন জেলেকে সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে। অপর ৫৩ জন জেলের ভাগে কী ঘটেছে, তা অজানা রয়ে গেছে তাদের পরিবারের নিকট। সাগরে নিখোজ ৫৩জেলের সন্ধানে স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবাসহ স্বজনরা প্রতিদিন সাগরপাড়ে যাওয়া-আসা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারপরও তাদের হারিয়ে যাওয়া গৃহকর্তার খোঁজ না পেয়ে প্রায় উন্মাদ বনে গেছেন অনেকে।
জানা গেছে, একই পরিবারে পিতার সঙ্গে পুত্র, নানার সঙ্গে নাতি, মামার সঙ্গে ভাগিনা, ভাইয়ের সঙ্গে ভাই, শশুরের সঙ্গে জামাই সহ একই পরিবারে ৩-৪ জন করে জেলে নিখোঁজ রয়েছে মহেশখালীর পুঠিবিলায়। ১ উদ্ধার হওয়া জেলেরা জানান, ২৯ মে ঘুর্ণিঝড় মোরার সিগন্যালের পর অসতর্কতার কারণে ৩০মে ভোর রাতে মোরার কবলে পড়ে তাদের ৫টি ফিশিং ট্রলার সাগরে ডুবে যায়। এরপর তারা কে কোথায় বা কোন দিকে গিয়ে ঠেকেছে, তাদের আর জানা নেই। অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সাগরে নিখোঁজ জেলেদের বাড়ি-ঘর। ওরা না পারছে শান্তিতে ঘরের ছালার নিচে ঘুমাতে। পারছে না গৃহকর্তার অনুপস্থিতিতে পেট ভরে খেতে। ঈদের কাপড় বা ঈদ বাজার ওসব পরিবারে উঠবে না। বড় মুসিবতে স্বজনহারা ৫৩ পরিবারের সদস্যরা দিনাতিপাত করছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: