ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতিচর্চা

প্রকাশিত: ০৭:১০, ২৪ জুন ২০১৭

সংস্কৃতিচর্চা

মানুষের জীবনাচরণে সংস্কৃতির প্রভাব গভীর। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা মানুষকে উদারতা শেখায়, সবার সঙ্গে সবার যোগে মিশতে শেখায়। সৃজনশীলতা তৈরি করে হৃদয় মঞ্জরিতে আনন্দে মাতিয়ে রাখে এবং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার মতো কাজে উজ্জীবিত করে। মেধা ও মননকে করে সমৃদ্ধ। একজন সম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার পথকে করে প্রশস্ত। সংস্কৃতি বিকাশ ঘটায় মানবতার ও মানবিকতার। প্রগতিশীল চেতনাকে করে শাণিত। সুন্দরের বর্ণিল আলোকছটায় রাঙিয়ে তোলে জীবন। কিন্তু অপসংস্কৃতির বিস্তার হলে জীবন হয়ে ওঠে অনুদার, অমানবিকতা ভর করে, অসুন্দরেরা মাথা চাড়া দেয়। শৈশবে শিশুরা যে পারিবারিক ম-লে বেড়ে ওঠে, সেখানে যে সংস্কৃতিচর্চা হয়, তাই তার মননকে তৈরি করে। প্রজন্মকে সুস্থ সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে এনে সৃষ্টিশীল, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা না গেলে সমাজ বিপন্ন হতে যেমন বাধ্য, তেমনি দেশ ও জাতির অগ্রগতির পথ হয় কণ্টকাকীর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একজন শিক্ষার্থীর মেধা ও মননকে তৈরি করে দেয়। আর এ ক্ষেত্রে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে সংস্কৃতির চর্চা তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। কিন্তু একালের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন শুধু পড়া কোচিং, পরীক্ষা আর অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতিচর্চা। অথচ শিক্ষা ক্ষেত্রে এক সময় সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলার ছিল অবারিত সুযোগ এবং চর্চা হতো নিয়মিত। শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাইরে নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ পেতেন। বিদ্যালয়ের পাঠাগারের বই পাঠের মাধ্যমেই গড়ে উঠত সাহিত্যচর্চার অভ্যাস। বই পড়ার সংস্কৃতি শিক্ষার্থীর মধ্যে চিন্তার প্রসার ঘটায়। নিয়মিত চর্চার একপর্যায়ে প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বার্ষিক নাটক, আবৃত্তি, সঙ্গীত, বিতর্ক, অভিনয়, কিরাত প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। হতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রকাশিত হতো বার্ষিক ম্যাগাজিন, দেয়াল পত্রিকা। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা প্রকাশ পেত এগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উদ্যোগেই ওইসব আয়োজন হতো। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি অবসরে নাট্যসঙ্গীত, বিতর্ক এবং সাহিত্যচর্চা করত। স্বাধীন বাংলাদেশেও এসবের চর্চা ছিল। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তারা মেধাহীন, মানবিক বোধহীন, শাসকের লেজুড়ও বংশবদ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায়ও শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াচর্চা বিমুখ করে তোলে। ফলে বনসাই প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। মেধা ও মননের বিকাশ হয়েছে ব্যাহত। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরের জগত সম্পর্কে গড়ে ওঠেনি সম্যক ধারণা। বরং রূঢ় চেতনার বিকাশ ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্ত শুভবোধ ও চেতনা যাতে জাগ্রত না হয়, মানবিকতা হয় অবিকশিত, সেই পথ ও পন্থাকেই সামরিক জান্তা শাসকরা বিস্তার ঘটিয়েছে এক অসংস্কৃত ও মনোবিকাশের। যার ফলে সমাজ হয়ে উঠেছে সাহিত্য-সংস্কৃতিবিমুখ এক অনুদার সমাজ। এই ধারার বিস্তারে আজ জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ ব্যাপকতা পেয়েছে। মাদকাসক্ত বেড়েছে। সংস্কৃতি মানবতার বিকাশের কথা বলেই জান্তা শাসকরা এর ঘোর বিরোধী ছিল। ফলে সাহসী ও দ্রোহী এবং সুশৃঙ্খল যুব সমাজ গড়ে ওঠেনি। মানবিক বিকাশের জন্য শিক্ষার্থীদের যে জায়গাটি ছিল এখন আর তা নেই। শিক্ষা হয়ে ওঠেছে স্রেফ ক্যারিয়ারসর্বস্ব। শিক্ষা অর্জন করছে স্রেফ কিভাবে অর্থ উপার্জন ও ব্যয় করা যায়। ফলে জীবনের বিরাট এক অংশ থেকে যাচ্ছে তাদের অপূর্ণ। সমাজে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের অভাব ঘটছে। বাইরের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো যোগ্যতা তৈরি হয়নি। শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। প্রকৃত মানব হিসেবে গড়ে ওঠার অপরিহার্য উপাদান সংস্কৃতিচর্চাহীনতা অনুভূতিহীন প্রজন্ম উপহার দিচ্ছে। সংস্কৃতিহীনতার বিপরীতে অবশেষে মাধমিক স্কুলে সাংস্কৃতিকচর্চা কার্যক্রম শুরুর যে উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়েছেন, তা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অসুস্থ ও জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরে আসার পথকে করবে উন্মোচিত। বাঙালীর সংস্কৃতিকে রুদ্ধ করার যে পথ পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী জান্তা শাসকরা নিয়েছিল, সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর এই কার্যক্রম অভিনন্দনযোগ্য।
×