ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিভা রানী রামমঙ্গল গায়েন

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২৪ জুন ২০১৭

বিভা রানী রামমঙ্গল গায়েন

রামমঙ্গল পরিবেশনাÑহিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। সাধারণত কারও মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিন রাতে রামমঙ্গলের আয়োজন করা হয়। এছাড়া শিশুর জন্মের একমাস পর মাসিক ব্রতের দিন এবং বিভিন্ন ধরণের মানত আদায়ে রামমঙ্গলের আয়োজন করতে দেখা যায়। এটি মূলত রামায়ণের কাহিনীভিত্তিক পরিবেশনা। রামায়ণের কাহিনীকে গান, অভিনয় আর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করাই হচ্ছেÑ রামমঙ্গল। তবে কেবল শিল্পী হলেই রামমঙ্গল গাওয়া যায় না। এটি পরিবেশন করতে বিশেষ পা-িত্যের দরকার পড়ে। রামায়ণের পুরো কাহিনী মুখস্থ থাকতে হয়। এছাড়া জানতে হয় রামমঙ্গলের সুর, তাল, ছন্দ এবং অভিনয়। নেত্রকোনা জেলার বেশ কয়েক গ্রামীণ শিল্পী পেশাদারিত্বের সঙ্গে রামমঙ্গল পরিবেশন করে থাকেন। তাদের মাঝে একমাত্র নারী শিল্পী হচ্ছেন বিভা গাইন (গায়েন)। আসল নাম বিভা রানী চক্রবর্তী। কিন্তু রামমঙ্গলের শিল্পী হওয়ায় তিনি এখন ‘বিভা গাইন’ নামে পরিচিত। বিভা রানীর বাড়ি সদর উপজেলার সিংহেরবাংলা ইউনিয়নের সহিলপুর গ্রামে। তার বাবা মদন মোহন আচার্য্য (মদন সরকার) এবং ঠাকুরদাদা বিজয় নারায়ণ আচার্য্য পূর্ব ময়মনসিংহের প্রখ্যাত কবিয়াল ছিলেন। পারিবারিক পরিবেশের প্রভাবেই তিনি গান-বাজনায় জড়িত হন। শৈশবে বাবার কাছ থেকে কবিগান শেখেন। পরে পার্শ্ববর্তী বর্নি গ্রামের গিরিন্দ্র গায়েনের কাছ থেকে রামমঙ্গলের তালিম নেন। রামমঙ্গল ছাড়াও কবিগান এবং বাউল গান পরিবেশন করতে পারেন তিনি। তবে রামমঙ্গলের গায়েন হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত। বিভা চক্রবর্তী জানান, ১৯ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামীর দ্বিতীয় সংসার থাকায় সেখানে বেশি দিন টিকতে পারেননি। এক মেয়ে জন্মের পর তাঁকে নিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়িতে। এরপর গানে মন দেন। গিরিন্দ্র গায়েনের সান্নিধ্যে রপ্ত করেন রামায়ণের সাতটি পালাÑ পুত্র পরিচয়, রাবণ বধ, মহি রাবণ বধ, শতস্কন্ধ রাবণ বধ, রাম-সীতার বিবাহ, লক্ষণের শক্তিসেল ও কলাবনের যুদ্ধ। লেখাপড়া না জানলেও এসব পালা-কাহিনী তিনি মুখস্থ এমনকি সুরে সুরে বলতে পারেন। পালাগুলো রপ্ত করার পর বিভা রানী আরও চার সহশিল্পী (খোল বাদক, হারমোনিয়াম বাদক, মন্দিরা বাদক ও দোহার) নিয়ে রামায়ণের দল গঠন করেন। টানা ৪৬ বছর ধরে রামমঙ্গল গান পরিবেশন করে আসছেন। গানের দল নিয়ে মাসের পর মাস চষে বেড়িয়েছেন নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগঞ্জ। একেকটি পালা পরিবেশন করতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। প্রতি পালা বাবদ সম্মানী পান তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এ টাকা দলের সবাই মিলে ভাগ করে নেয়। এটাই তাদের জীবন-জীবিকার উৎস। কিন্তু এখন আর আগের মতো বায়না হয় না বিভা রানীদের। এই লোকশিল্পী বলেন, সংগ্রামের বছর থেকে গান করি। প্রচুর পালা গাইছি। গানের জন্য দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে থাকছি। কিন্তু অহন আগের মতো বায়না পাই না। বায়না কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিভা রানী বলেন, একে তো রামমঙ্গলের প্রতি মানুষের টান কমছে। দ্বিতীয়ত আমি নিজেও বুড়ি হয়ে গেছি। আগের মতো শক্তি দিয়ে গাইতে পারি না। এ কারণেও অনেকে আমারে আর আগের মতো টানে না। এসব কারণে খুব কষ্টে আছি। এক সময়ের তুখোড় রামমঙ্গল শিল্পী বিভা রানী চক্রবর্তী এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাম সংকীর্তন করে কিছু চাল এবং টাকা জোগাড় করেন। এভাবে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কোন রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। স্বভাব কবি বিভা রানী তার জীবদ্দশাকে বর্ণনা করেন এভাবেÑ ‘বাংলা আমার বসতবাড়ি, সহিলপুর গ্রাম/মদন ঠাকুরের ছোট মেয়েÑ বিভা রানী নাম/জন্মভরা দুঃখ করি, দুঃখের নাই শেষ/সদাই ঘুরি আমি পাগলেরই বেশ’। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×