ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে লোকপালা ॥ গাজী কালু চম্পাবতী

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২৪ জুন ২০১৭

বিলুপ্তির পথে লোকপালা ॥ গাজী কালু চম্পাবতী

আকাশ সংস্কৃতির যুগে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার চিরচেনা গাজী-কালু ও চম্পাবতীর পালাগান। নানা প্রতিকূলতার মাঝে এখনও দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি উপজেলায় মাঝে মধ্যে দেখা মেলে রাতভরের গাজী কালুর গান। এ গানের দলে নারী অভিনেত্রী না থাকলেও নারী চরিত্রে পুরুষ অভিনয় করে দর্শকদের আকৃষ্ট করে। তাদের অভিনয় দেখে কখনও দর্শক হাসে, আবার কখনও বা কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসায়। জনশ্রুতি রয়েছে গ্রামের লোকজন বিপদ আপদ, রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার আশায় গাজীর গানের মানত করে। নিয়ত সহি হলে তাদের বাসনা পূর্ণ হয়। সম্প্রতি গাজী-কালু গানের দলের পরিচালক বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের আইউব আলী কমান্ডার বলেন, ২০ বছর আগে তিনি গাজী কালুর গানের দল তৈরি করেন। তাকে সহায়তায় এগিয়ে আসেন গাজী-কালুর আরেক ভক্ত কালনা গ্রামের এস্কেন্দার মল্লিক। তাদের দলে মোট সদস্য সংখ্যা ২৪, তবে কোন নারী নেই। পুরুষ নারী সেজে নারী চরিত্রে অভিনয় করে। সম্প্রতি গাজীর গানের আসর বসেছিল গৌরনদীর চরদিয়াশুর গ্রামের শাজাহান বেপারীর বাড়িতে। নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে বসত বাড়ি রক্ষার জন্য শাহজাহান তার বাড়িতে গাজীর গানের আসর বসানোর মানত করে সুফল পেয়েছেন। তাই তিনি বাড়িতে গাজী কালুর গানের আসর বসিয়েছেন। ওই অনুষ্ঠান দেখার জন্য দূর দূরান্তের শত শত নারী-পুরুষের সমাগম হয়। সেখানে বসে গানের দলের আইউব আলী কমান্ডার জানান, গ্রামের মানুষের কাছে গাজী-কালুর গানের কদর আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শুকনো মৌসুমে প্রতিদিনই তাদের বায়না থাকে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও তার দলের কদর অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, আর্থিক সঙ্কটের কারণে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে দল চালাচ্ছেন। অভিনেতা, অভিনেত্রী, বাঘ-ভাল্লুক, হাতির পোশাক কিনতে পারছেন না টাকার অভাবে। দিন দিন খরচ বাড়ছে তাই বায়নার টাকায় দল ঠিক রাখা যায় না। আইউব আলীর মতে, গরিব লোকজন গাজী-কালুর গানের বেশি ভক্ত। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে¡ও তারা বেশি টাকা দিতে পারে না। এ কারণে যারা অভিনয় করে তারা নিজের জন্য নয়, পরের জন্য বিনে পয়সায় কাজ করে। প্রবীণ দলনেতা এসকেন্দার মল্লিক জানান, গাজী-কালুর গানের দলে নারী চরিত্রে পুরুষ অভিনয় করে। এটা গাজীর গানের নিয়ম। ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে এখানে নারীদের দিয়ে অভিনয় করানো নিষেধ। তিনি আরও জানান, প্রতি পূর্ণিমার রাতে গাজী-কালুর শিরনি হয়। গাজীর শিরনিতে লোকজন আর্থিক সহায়তা করে। এছাড়া বছরে একবার দলপতির বাড়িতেও বড় আকারে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আর্থিক সঙ্কটের কারণে অনেক গাজী-কালুর গানের দল ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্যতম গানের দল ছিল আশোকাঠিতে। বিলুপ্ত ওই দলের দলনেতা বাদশা মিয়া জানান, তার দলের শিল্পীরা দেশব্যাপী গাজী-কালুর গান পরিবেশন করে একসময় ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির যুগে এ গানের কদর কমে যাওয়ায় আর্থিক সঙ্কটের কারণে তিনি দল বিলুপ্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর দলের শক্তিমান অভিনেতা জল্লাদ গনি সরদার এখন স্থানীয় বাজারে মাছ বিক্রি করেন। ছোট গাজীর অভিনেতা রিপন প্যাদাকে এখনও মানুষ গাজী নামেই ডাকে। এখন দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। রাজার চরিত্রের অভিনেতা আব্দুর রব সরদার বয়সের ভারে নিস্তেজ হয়ে গেছেন। গাজী-কালু গানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ॥ গাজীর বাবা ছিলেন বৈরাটনগরের শাসক সেকেন্দার শাহ। এই শাহের প্রথম রানী অজুফা সুন্দরীর গর্ভে গিয়াসউদ্দিন, যিনি জুলহাস নামেও পরিচিত এবং বরখান গাজী জন্মগ্রহণ করে। অজুফা সুন্দরীর পালিত ছেলের নাম ছিল কালু। রাজা ও রানীর বড় ছেলে জুলহাস শিকারে গিয়ে হারিয়ে গেলে এরপর বয়সেযোগ্য গাজীকে রাজকর্মভার গ্রহণ করতে বলা হয়। কিন্তু গাজী সাধারণের মতো ছিলেন না। তিনি রাজকার্যভার গ্রহণ করার বদলে ফকির হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বাবার আদেশও গাজী প্রত্যাখ্যান করেন। এজন্য তার ওপর অত্যাচার চালানো হয়। তা সত্ত্বে¡ও গাজী তার ইচ্ছা থেকে সরে আসেননি। রাজার আদেশে জল্লাদ তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে কিন্তু দৈব কারণে গাজীর ক্ষতি হয়নি (শ্রুতিমতে, একটি লোমও কাটা যায়নি)। এরপর তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করা হলেও গাজীর কিছু হয় না। এরপর গাজীকে পাথরের সঙ্গে বেঁধে সুচসহ সমুদ্রে ফেলা হয়। তার আগে গাজীকে বলা হয়, দৈবশক্তি থাকলে সাগর থেকে এই সুচ উদ্ধার করতে হবে। অবশেষে সাগর শুকিয়ে যায় এবং খোয়াজ খিজিরের সহায়তায় সুচ পাওয়া যায় এবং গাজী মহানন্দে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন। এরপর গাজীর সঙ্গে কালুও রাজসিংহাসন ছেড়ে ফকিরি জীবন বেছে নিয়ে বনবাসে চলে যান। তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় জঙ্গলের বাঘ, কুমিরও বশীভূত হয়। গাজীর দ্বিতীয় পর্বটি শুরু হয় ছাপাইনগরের মুকুট রাজার (মতান্তরে শ্রীরাম রাজা) কন্যা চম্পাবতীর প্রেমে পড়া নিয়ে। চম্পাবতী সাত ভাইয়ের এক বোন। গাজী চম্পাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে ভাই কালুর মাধ্যমে রাজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। সেই প্রস্তাবে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে কালুকে বন্দী করেন। ফলে গাজী মুকুট রাজার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গাজী অসংখ্য বাঘ নিয়ে নদী পার হয়ে মুকুট রাজার রাজধানীতে আক্রমণ করেন। অন্যপক্ষে মুকুট রাজার মূল সেনাপতি হলেন মিথের আরেক জনপ্রিয় চরিত্র দক্ষিণ রায়। সে কুমির নিয়ে গাজীর সঙ্গে যুদ্ধে নামে। তবে গাজীর দৈব শক্তির কাছে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়। এ খবর মুকুট রাজা শুনতে পেয়ে তিনি নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মুকুট রাজার মূল কৌশল ছিল হাজার হাজার সেনার সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনী অর্থাৎ তোপ-তীর সজ্জিত বাহিনী। মুকুট রায়ের আরেকটি কৌশল ছিল মৃত্যুঞ্জীব কূপ থেকে জল নিয়ে মৃত সৈন্য-হাতি ও ঘোড়াদের পুনর্জীবিত করা। গাজী এ খবর শুনতে পেয়ে ওই কূপে গোমাংস নিক্ষেপ করে বাঘ ও পরীদের সহায়তায় যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে চম্পাবতীকে জয় করেন। পুঁথি অনুযায়ী গাজী-কালু ও চম্পাবতীর গল্প এমনই। অঞ্চলভেদে পুঁথির এই গল্পের অল্প বিস্তর এদিক-ওদিক হয়েছে। কিন্তু গাজীর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বিস্ময় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। -খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে
×