বিকাশ দত্ত ॥ বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর ধরে চার শতাধিক আসামি কারাগারে আটক রয়েছে। তাদের আইনী সহায়তা দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। এমনই এক আসামি মোঃ শিপন দীর্ঘ ১৬ বছর কারাগারে আটক ছিলেন। সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির সহায়তায় সম্প্রতি মামলা নিষ্পত্তি শেষে কারাগার থেকে খালাস পেয়েছেন। এবার আত্মীয় স্বজন নিয়ে ঈদ উদযাপন করবেন। তার মামলাও নিষ্পত্তি হয়েছে। দীর্ঘদিন কারাগারে আটক থাকার কারণে তারা আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেজন্য শিপন এবার ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা দায়েরের চিন্তাভাবনা করছেন। শুধু শিপন নয়, তার মতো এক যুগ আটক থাকার পর লিটন সাংমাও ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা করার কথা ভাবছেন, তারা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাও করছেন বলে জানা গেছে। শুধু তারা দুই জনই নয় এমন ১৮ জন আসামি জামিন পেয়েছে। আর চার জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। আদালত অন্যান্য ৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে মামলা নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আসামি আব্দুস সাত্তারকে উচ্চ আদালত জামিন প্রদান করেন। এবং তার মামলাটি ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্ত নিম্ন আদালত আব্দুস সাত্তারকে ফাঁসি প্রদান করেছেন। সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি এই ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা হবে।
এদিকে শিপন ও লিটন সাংমাও মতো আরও কয়েক জনের মামলা নিষ্পত্তি শেষে খালাস পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। লিটন সাংমার ভাই লাবলু সাংমা জনকণ্ঠকে বলেন, মিথ্যা মামলায় তার ভাইকে ফাঁসানো হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ ১২ বছর বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কারাগারে চার দেয়ালে আটক ছিল। সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইডের কারণে তার ভাই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। এখন আলোর মুখ দেখছে। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে লিটন বর্তমানে নেত্রকোনায় দিনমজুরির কাজ করছে। এক যুগ কারাগারে থাকার ফলে তার যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য মামলা করতে চায়। কিন্তু মামলা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। লিটন সাংমা, পিতা- প্রসেন সাংমা, গ্রাম- চেংগিনি, থানা- কলমাকান্দা, জেলা- নেত্রকোনা। উত্তরা থানার একটি হত্যা মামলায় নেত্রকোনার গারো যুবক এক যুগ ধরে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কারাগারে আটক থাকার পর ২৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছেন। শুধু শিপন ও লিটনই নয় ইতমধ্যে উচ্চ আদালত ১৮ আসামিকে জামিন দিয়েছেন। এবং অন্য ৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে মামলা নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ১৬ বছর ধরে জেলে থাকার পর জামিন পান রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকার বাসিন্দা মোঃ শিপন। তার বিরুদ্ধে আনা মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে জামিন দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জে বি এম হাসান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। দুই মাসের মধ্যে তার মামলার নিষ্পত্তিরও আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। বর্তমানে তার মামলাটি নিষ্পত্তি শেষে তিনি এখন খালাস। এবার আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করবেন। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ১৯৯৪ সালে দুই মহল্লার মধ্যে মারামারিতে একজন খুন হন। এ ঘটনায় মোঃ জাবেদ বাদী হয়ে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন। মামলার দুই নম্বর আসামি ছিল মোঃ শিপন। এফআইআরে তার বাবার নাম ছিল অজ্ঞাত। পরে চার্জশীটে তার বাবার নাম মোঃ রফিক দেয়া হয়। ঠিকানা ৫৯, গোয়ালঘটা লেন, সূত্রাপুর বলে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় ২০০০ সালের ৭ নবেম্বর গ্রেফতার হন শিপন। তখন থেকেই তিন কারাগারে ছিলেন। হাইকোর্ট তাকে ৩০ অক্টোবর জামিন প্রদান করেন।
সুপ্রীমকোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটি গত বছরের ১৬ নবেম্বর বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক বন্দীদের তালিকা চেয়ে দেশের সকল কারাগারে চিঠি পাঠায়। ঐ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ ডিসেম্বর আইজি প্রিজন বিভিন্ন কারাগারে ৫ থেকে তদুর্ধ সময়ে বিচারাধীন আটক বন্দীদের তালিকা সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটিতে পাঠায়। ঐ তালিকায় মোট ৪৬২ জন বন্দী রয়েছেন। এখন ঐ তালিকা থেকে প্রত্যেক বন্দীর জীবন বৃত্তান্ত, কারাভিত্তিক পরিসংখ্যান, নারী পুরুষের সংখ্যা এবং আসামিদের বিরুদ্ধে অন্য কি কি অভিযোগ আছে তা বের করে লিগ্যাল এইডের আইনজীবীগণ আদালতের সামনে উপস্থাপন করছেন। আদালত শুনানি শেষে তাদের বিষয়ে আদেশ প্রদান করছেন।
যে সমস্ত বন্দী আইনজীবীর অভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারছিলেন না তাদের জন্য এগিয়ে এসেছে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। বর্তমানে গরিবের অফিস বললেই এক নামে সরকারী লিগ্যাল এইড অফিসকে দেখিয়ে দেয়া হয়। সুপ্রীমকোর্টে সরকারী আইনী সেবা চালু হবার পর মাত্র ১৬ মাসেই ৫৩৬ জন আইনী সহায়তার জন্য আবেদন করলে তাদের মধ্যে ৪৭৩ জনকে আইনী সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের কর্মকর্তা রিপন পৌল স্কু জনকণ্ঠকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে সুপ্রীমকোর্ট কমিটি অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কার্যকর আইনী সেবা প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন। পাশাপাশি জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ও সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনও সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছেন, যার ফলে সরকারী আইনী সেবা প্রদান সহজতর হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যারা বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কারাগার আটক ছিলেন কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিন পেয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন খালাসও পেয়েছেন, তারা ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা দায়ের করতে চান। ওরা চাইলে আমাদের কাছে আবেদন করতে পারেন। আমাদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। অনুমতি দিলে রিটের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। যেহেতু ক্ষতিপূরণের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন আইন বিদ্যমান নাই। তবে অবশ্যই রিট করা যাবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে আটক অপরাধীরা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তাদের বিচার শুরুই হয়নি। বিষয়ে আদালতের নজরে আনার পর ঐ আসামিদের হাজিরের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এটা আদালতের সময়োপযোগী উদ্যোগ। এতে করে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এগুলো অমানবিক কাজ। এগুলো কোনভাবেই আইনের শাসন সমর্থন করে না। আইনের শাসন হচ্ছে কেউ অপরাধ করলে, সেই অপরাধের বিচার করা। বিচারই শুরু হলো না, তারপরও তাকে কারাগারে আটক থাকতে হলো ১৫ থেকে ১৮ বছর। আদালত সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য আদেশ প্রদান করছেন।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: