ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শহুরে সংস্কৃতির নতুন অনুষঙ্গ, মধ্যরাতে চমৎকার মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৪ জুন ২০১৭

শহুরে সংস্কৃতির নতুন অনুষঙ্গ, মধ্যরাতে চমৎকার মিলনমেলা

মোরসালিন মিজান ॥ ইফতার পার্টি এখন পুরনো বটে। শহুরে সংস্কৃতিতে যোগ হয়েছে নতুন অনুষঙ্গ। শুধু যোগ হয়েছে বললে ভুল হবে, রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সেহরি পার্টি। ভিন্নতার সন্ধানে ছোটা তরুণ প্রজন্ম লুফে নিয়েছে। প্রবীণরাও বসে নেই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মধ্য রাতে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ছেন। এত খোঁজাখুঁজির দরকার হচ্ছে না, এখানে ওখানে গড়ে উঠেছে রেস্তরাঁ। আকর্ষণীয় মেন্যু। দারুণ সব অফার। মুখরোচক খাবারের স্বাদ গ্রহণ করার পাশাপাশি চলছে গল্প আড্ডা। সেলফি তো না হলেই নয়! খাবারসমেত ছবি তুলে মুহূর্তেই তা আপলোড করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এভাবে রমজানের রাতগুলো পেয়েছে নতুন মাত্রা। বিশেষ আনন্দঘন হয়ে উঠছে সেহরি টাইম। সেহরি পার্টি সাম্প্রতিককালের সংস্কৃতি। কয়েক বছর ধরে ঢাকার অভিজাত রেস্তরাঁগুলোতে এ ধরনের আয়োজন দেখা যাচ্ছে। শুরুটা কীভাবে? এমন প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর নেই কারও কাছে। তবে অনুসন্ধানে নেমে মনে হয়েছে, সূচনা হয়েছে পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকার অনেক এলাকা সারা রাত কর্মচঞ্চল থাকে। ব্যবসায়িক কারণে রাতগুলো দিনের চেহারা পায়। খোলা থাকে দোকানপাট। সরু রাস্তার ধারে অসংখ্য রেস্তরাঁ। ছোট ছোট রেস্তরাঁয় গরমাগরম খাবার। মোঘল ঐতিহ্যের খাবারের টানে নতুন ঢাকার ভোজনবিলাসীরাও ছুটে যান। আর রমজানে তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়ে যায় কয়েকগুণ। চাহিদা দেখে সেহরির জন্য স্পেশাল মেন্যু প্রস্তুত করতে শুরু করে নামীদামী রেস্তরাঁগুলোও। একটু অন্যরকম সময়। তাই উপভোগ করতে শুরু করে তরুণ প্রজন্ম। আর তার পর উচ্চবিত্তরা আয়োজনটিকে সেহরি পার্টির রূপ দেন। নতুন ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতেও অনেক খাবারের রেস্তরাঁ। এসব রেস্তরাঁয় বিদেশীদের পাশাপাশি বাঙালীরাও পরিবার পরিজন নিয়ে ডিনার করেন। রমজানে ডিনারটাই হয়ে ওঠেছে সেহরি পার্টি! এখন রমজানে বহু রেস্তঁরা শেষ রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। দিনের কোন মেন্যু বাদ যায় না। বরং অতিথিদের আকর্ষণ করতে সেহরিতে নতুন নতুন মেন্যু যোগ করা হয়। শুধু সেহরির জন্য অনেক রেস্তঁরা আলাদা খ্যাতি অর্জন করেছে। বৃহস্পতিবার রাতে পুরান ঢাকা ধানম-ি গুলশান বনানীনসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আরও জমে ওঠেছে সেহরি পার্টি। এসব এলাকার বিভিন্ন রেস্তরাঁ দিনের বেলার মতোই খোলা। বাইরে আলো ঝলমলে পরিবেশ। ভেতরে উৎসবের আমেজ। টেবিলে সাজানো প্রিয় খাবার। হৈ-হুল্লোড় আড্ডা গল্প চলছে। চলছে সেহরি। পুরান ঢাকার নর্থসাউথ রোডে অবস্থিত হোটেল আল-রাজ্জাক। কয়েক বছর ধরে সেহরির জন্য বিশেষ আলোচিত এই রেস্তরাঁ। রাত ১২টা ৪৭ মিনিটে সেখানে পৌঁছে দেখা যায়, রেস্তরাঁর সামনের জায়গাটা ব্যক্তিগত গাড়ির হয়ে গেছে। নতুন করে গাড়ি রাখার তেমন সুযোগ নেই। পাশে এক জায়গায় গাড়ি রেখে রেস্তরাঁয় প্রবেশ করতেই দেখা গেল, অনেকটা জায়গা। বেশ বড় পরিসর। কিন্তু সেহরি করতে আসা লোকজনের সংখ্যা এত বেশি যে, জায়গাটাকে রীতিমতো ঘিঞ্জি মনে হচ্ছিল! সতর্ক পায়ে সামনে এগোনোর পরও কয়েকজনকে ‘সরি’ বলতে হলো। অবশ্য ‘সরি’ শোনার সময় কোথায়? যে যার মতো ছুটছিলেন। কোন টেবিল খালি হওয়া মাত্রই বসে পড়ছিলেন। তেমন একটি দলকে অনুসরণ করে দেখা গেল, ১৬ মিনিট পর সফল হয়েছেন তারা। এক পরিবারের ৬ সদস্য। বাবা-মা ভাইবোন একসঙ্গে বসতে পেরে সে কী আনন্দ! যেন যুদ্ধে জয় হলো! পরিবারের কর্তা ব্যবসায়ী ইফতেখার আহমেদ বললেন, ছেলেমেয়েদের দাবি। আসি আসি করছিলাম। কিন্তু সময় করতে পারছিলাম না। আজ গিন্নি বলল যেতেই হবে। তাই আসা। প্রথমে ভেবেছিলাম, এত রাতে কিসের খাওয়া-দাওয়া হবে কে জানে। এখন তো দেখছি দিনের মতো ব্যাপার! দ্বিতীয়তলায় ভিড়টা তখনও কম ছিল। সেখানে একাধিক টেবিল জোড়া দিয়ে বসানো হয়েছিল ১০ জনকে। হৈ-হুল্লোড় আর মোবাইল ফোনে সেলফি তোলা দেখে বোঝা যায়, বন্ধুরা মিলে এসেছেন। একজনের নাম সিফাত। এক ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, প্রতি রোজায় আমরা ইফতার পার্টির আয়োজন করতাম। এখন সেহরি পার্টিটা এনজয় করি বেশি। যানজট থাকে না। গরমটাও কমে আসে। তাই রাতটা বেছে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। রেস্তরাঁর কর্মীরাও চরকির মতো এই টেবিল ওই টেবিল ঘুরছিলেন। ক্যাশ কাউন্টারে বসা একাধিক ব্যক্তি। ম্যানেজার মোঃ জাবেদের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিতে হলো। তিনি বললেন, রাত ১২টার পর থেকে শুরু হয়ে যায় সেহরি পার্টি। রাত যত বাড়ে আমার কাস্টমার তত বাড়তে থাকে। আল-রাজ্জাকে একসঙ্গে ৪০০ মানুষ খেতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, সেহরির সময় আমরা সবাইকে জায়গা দিতে পারি না। এই রেস্তরাঁয় সেহরির আয়োজন কবে থেকে চলছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে তো ২৫ বছর আগের কথা। হোটেল চালুর পর থেকেই সেহরির ব্যবস্থা ছিল। তবে এখন বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। অনেক দূর থেকে অতিথিরা সপরিবারে খেতে আসেন। তরুণরা দল বেঁধে আসেন। এখন অন্যরকম হয়ে গেছে সব। সেহরিতে মোরগ পোলাও, নান রুটি, সাদা ভাত, মাটন লেগ, রোস্ট মাটন গ্লাসি মাটন, রেজালা, মুরগির ফুল রোস্ট, মুরগির চাটনি, মুরগির মোসলালাম, মুরগির কারীসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি। আল-রাজ্জাক থেকে কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিরা বাজার হয়ে ফিরে আসার সময় যানজটে অস্থির হয়ে যেতে হয়। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, অসংখ্য রেস্তরাঁর সবগুলোতে চলছে সেহরি। বিভিন্ন এলাকা থেকে রোজাদার আসছেন। এ কারণেই যানজট। ধানম-িতে সেহরি পার্টির জন্য বিখ্যাত সুলতান’স ডাইন। অল্প সময়ে ভাল পরিচিতি পেয়েছে এই রেস্তরাঁ। রাত ১টা ৫৫ মিনিটে সেখানে পৌঁছে দেখা যায়, অদ্ভুত সব ব্যাপার। রেস্তরাঁর নিচের রাস্তায় অনেকেই দাঁড়িয়ে অন্যদের আসার অপেক্ষা করছিলেন। তরুণ তরুণীদের দেখে মনে হচ্ছিল কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস! রেস্তরাঁটি দ্বিতীয়তলায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কাঁচের দরজার সামনে অনেকগুলো চেয়ার পাতা। সেখানে বসে অপেক্ষা করছেন একদল অতিথি। কখন টেবিল খালি হবে, সেই প্রতিক্ষা! এ অবস্থায় ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল, পুরোদমে চলছে সেহরি পার্টি। অল্প পরিসরে সুন্দর সাজানো গুছানো রেস্তরাঁ। প্রায় সব টেবিলেই খাবার গ্রহণে ব্যস্ত মানুষ। দুটি টেবিল শূন্য দেখালেও জানা গেল, ওগুলো অগ্রিম বুকিং দেয়া আছে। এখানে খাবার মেন্যুটাও খুব আকর্ষণীয়। কাচ্চি, মোরগ পোলাও, প্লেন পোলাও, চিকেন রোস্ট, জালি কাবাব, বিফ রেজালা, জর্দাসহ নানা আইটেম দিয়ে সেহরির সুযোগ কাজে লাগাচ্ছিলেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এখানে পারিবারিক আবহটাই বেশি চোখে পড়ল। নারীরা এসেছিলেন। এসেছিল শিশুরাও। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেহরি করতে এসেছিল হৃদি। এখনও স্কুল পড়ুয়া। বললেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছি। আমার বন্ধুরা খুব আসে। এবার ঈদের কেনাকাটার জন্য আমাদের আসতে দেরি হয়েছে। মা আমিনা আক্তারও খুশি বলে মনে হচ্ছিল। বললেন, সবাই ব্যস্ত এখন। চাইলেই একসঙ্গে হতে পারি না। আজকে সে সুযোগ হলো। মুহূর্তটা কোনদিন ভুলতে পারবেন না বলে জানান তিনি। রেস্তরাঁর ক্যাশ কাউন্টারের পাশেই দাঁড়িয়ে সব তদারকি করছিলেন তরুণ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফয়সাল আহমেদ। বললেন, জেনারেশন চেঞ্জ হচ্ছে। সেই চেঞ্জের কথা মাথায় রেখেই গভীর রাতে আমরা রেস্তরাঁ খোলা রাখছি। রমজানের নবম দিন থেকে এখানে সেহরির আয়োজন চলছে। এখনও অব্যাহত। একসঙ্গে ১২০ জনের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি আমরা। কিন্তু চাহিদা কয়েকগুণ। ফলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। কথা বলতে বলতেই একজনকে ডেকে তিনি গেস্ট আর রিসিভ না করার নির্দেশ দিলেন। নিচে নেমে আসার সময় দেখা গেল, অতিথিরা বিষণœ মনেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। গুলশান বনানীর মতো অভিজাত এলাকাগুলোতে সেহরি পার্টি আরও জমজমাট হওয়ার কথা। কিন্তু হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর চিত্রটা বদলে গেছে বলে মনে হলো। কয়েক দফা নিরাপত্তা তল্লাশির পর এসব এলাকায় প্রবেশ করা সম্ভব হয়। অনেক রেস্তরাঁই আর খোলা পাওয়া যায়নি। কোন কোনটি খোলা থাকলেও অতিথিদের উপস্থিতি ছিল কম। রাত আড়াইটার দিকে গুলশানের ‘হাক্কা ঢাকা’ নামের রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, একটি টেবিলে চলছে সেহরি পার্টি। অন্যগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ম্যানেজার মিরাজ জানান, নিরাপত্তা ইস্যু বড় হয়ে দেখা দেয়ায় সেহরির সময় তাদের কাস্টমার কমে গেছে। প্রমোশনাল কার্যক্রম চালাতে রেস্তরাঁ খোলা রেখেছেন বলে জানান তিনি। তবে ‘চিটাগাং এক্সপ্রেস’ নামের রেস্তরাঁটিতে গিয়ে দেখা যায়, ভরপুর উপস্থিতি। উৎসবের আমেজ। প্রায় প্রতিটি টেবিল পরিপূর্ণ। সোহরাব উদ্দিন নামের এক প্রবীণ খেতে খেতে বললেন, নাতির সঙ্গে এসেছি। সেহরিটাও যে এত আনন্দের হতে পারে এখানে না আসলে বুঝতাম না। রেস্তরাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার মফিজুর রহমান জানান, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি গোস্ত, মেজবানি ডাল, পায়া, কালাভুনা, চিকেন রোস্ট, আখনি, বিরিয়ানিসহ অনেক সুস্বাধু খাবার সেহরিতে রাখা হচ্ছে। এসব খাবারের কারণেই ভোজনবিলাসীরা রেস্তরাঁটি খুঁজে নেন বলে জানান তিনি। এসবের বাইরে রাজধানীর ঢাকা ক্লাবসহ অভিজাত অনেক ক্লাব ও হোটেলে সেহরি পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে প্রতিদিন। ব্যস্ততা যানজট অসহ্য গরম এড়িয়ে নগরবাসী চমৎকার উপভোগ করছেন নতুন এই আয়োজন।
×