ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে দেশ ছাড়ছেন তিন লাখ, ঘরে ফিরছেন ২ লাখ

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৪ জুন ২০১৭

ঈদে দেশ ছাড়ছেন তিন লাখ, ঘরে ফিরছেন ২ লাখ

আজাদ সুলায়মান ॥ পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উদযাপন করতে কমপক্ষে তিন লাখ লোক দেশের বাইরে যাচ্ছেন। আবার স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে কমপক্ষে ২ লাখ প্রবাসী ঘরে ফিরছেন। গত এক সপ্তাহে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘরমুখো প্রবাসী যাত্রীদের ব্যাপকতা ছিল চোখে পড়ার মতো। আবার একই হারে দেশ ছাড়ছেন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষও। ইমিগ্রেশন ও ট্যুর অপারেটর পরিসংখ্যান থেকে এ ধরনের চিত্র ফুটে উঠেছে। আজ এবং কাল বিমানবন্দরের ওপর এ চাপ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ। এ বিষয়ে ট্যুর অপারেটর এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) জানিয়েছে, এবারের ঈদে কমপক্ষে তিন লাখ লোক দেশের বাইরে যাবেন। বেশিরভাগের পছন্দের শীর্ষে মালয়েশিয়া। এ বছর লম্বা ছুটির কারণেই ঈদে বহির্মুখীর সংখ্যা বেড়েছে। সমাজের এই শ্রেণীর মতে- দেশের বাইরে ঈদ করা এখন একটি সাধারণ বিনোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দশ বছরে দেশের বাইরে ঈদ উদযাপন করা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। শুক্রবার সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রচুর ঘরমুখো যাত্রীর চাপ দেখা যায়। সকাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশী-বিদেশী প্রতিটি এয়ারলাইন্সেই যাত্রী এসেছে। কোন ফ্লাইটের আসনই খালি ছিল না। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসছে সৌদি আরব থেকে। প্রায় বিশ লাখ বাংলাদেশী এই মরুর দেশে কাজ করছে। এবারের ঈদের কমপক্ষে এক লাখ সৌদি প্রবাসী ঘরে ফিরেছে বলে জানিয়েছে ইমিগ্রেশন শাখা। সৌদির পরই সবচেয়ে বেশি প্রবাসী ফিরছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, মালয়েশিয়া ও ওমান থেকে। সৌদি আরব থেকে আসা মাসুদ আহমেদ বলেন, যারা একটু বেশি বেতন পায়, অথচ দুবছর ধরে দেশে আসেনি তারাই ঈদ করার জন্য আসছে। অনেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েও আসছে। বিদেশে ঈদ করাার চেয়ে দেশে প্রিয়জনদের সঙ্গে থাকাটার মূল্য অনেক বেশি। গত দুই বছর সৌদিতে ঈদ করার পর এবার আর মন মানছিল না। তাই চলে এলাম। দুবাই প্রবাসী মাসুদ জানান, তিনি একেবারে চলে এসেছেন। তার চাকরির মেয়াদ শেষ হবার কথা ছিল আগামী ২৩ জুলাই। কিন্তু গত ক’বছর ধরে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে না পারায় এবার এক মাস ভিসার মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও একেবারে গুটিয়ে চলে আসতে হয়েছে। কুয়েত থেকে আসা সুলতানা ইয়াসমীন জানালেন, তিন বছর পর তিনি ফিরেছেন। শুক্রবার ভোর থেকেই তার জন্য স্বজনরা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন। তাদের নিয়ে একত্রে ঘরে ফেরার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করেছেন। সুলতানা বলেন, ছুটি কম। মাত্র দুসপ্তাহের জন্য দেশে এসেছি। ঈদের পর দিন দশেক থাকার পর আবার চলে যেতে হবে। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের এএসপি তারিক আহমেদ জানান, এমনিতে সব সময়ই ঈদে ঘরমুখো যাত্রীর সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু এবার প্রবণতা অনেক বেশি। সৌদির অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হওয়া, তেলের দাম কমা, ও এমনেস্টি ঘোষণা করায় অনেক অবৈধ বাংলাদেশী এবার দেশে এসেছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের সামনের ক্যানপী এলাকায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। এত ভিড় আগে দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে বলা চলে কমপক্ষে লাখ দুয়েক প্রবাসী এবার ঈদ করতে দেশে এসেছেন। আজ ও কাল এ সংখ্যা আরও বাড়বে। টোয়াব সূত্র জানায়, ঈদে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের সঙ্গে ভুটান, নেপাল শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণের আগ্রহ বাড়ছে মানুষের। সেই অনুপাতে কোন একটি বিশেষ সময়কে কেন্দ্র করে ভিনদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না বাংলাদেশ। পর্যটন কর্পোরেশন নিজস্ব উদ্যোগে যৎসামান্য উদ্যোগ নিলেও সেটা আমলে নেয়ার মতো নয়। মূলত বেসরকারী ট্যুর অপারেটরদের উদ্যোগে ঈদে কিছু সংখ্যক বিদেশী পর্যটক আনা হচ্ছে। বিদেশে ঈদ করার বিষয়ে ব্যবসায়ী হাসান মাহমুদ জানান, তিনি মালয়েশিয়ায় চকোলেটের ব্যবসা করেন। সেখানে নিয়মিত যেতে হয়। তবে কখনোই সেখানে ঈদ করা হয়নি। তাই এবার তিনি সেখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদ করার জন্য গত বৃহস্পতিবার ঢাকা ছেড়েছেন। ফিরবেন আগামী বৃহ¯পতিবার। এতে তার ৭ দিন সেখানে থাকা হবে। তার মতো মারুফ মান্নান এবার বাবা মা স্ত্রী নিয়ে ঈদ করবেন সিঙ্গাপুর। তিনি বাবাকে চেকআপের জন্য মা-বাবাসহ স্ত্রী তামান্নাকে যাচ্ছেন সিঙ্গাপুরে। ঈদ ও চিকিৎসা- এক সঙ্গে রথ দেখা কলা বেচা দুটোই সেরে ফেলা হবে। আটাব সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান জানান, এবার মানুষের দেশের বাইরে যাওয়ার হার একটু কম দেখা যাচ্ছে। দুই তিন বছর আগে ঈদের এক মাস আগে থেকে সিঙ্গাপুর, থ্যাইল্যান্ডের টিকেট সঙ্কট দেখা যেত। এবার তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। কারণ হয়তবা মানুষের হাতে টাকা কম। ঈদ সামনে রেখে বিদেশ থেকে অনেকই দেশে আসে স্বজনের সঙ্গে ঈদ করতে। এবার সে সংখ্যা কম। এ বছর তার ট্রাভেল এজেন্সি থেকে সিঙ্গাপুর, বালি, থাইল্যান্ডে মানুষ বেশি যাচ্ছে। এর বাইরে কিছু মানুষ যাচ্ছে ইউরোপে। গত বছর যারা এশিয়ার দেশে ঘুরেছেন তাদের প্রায় ৫০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ এবার ইউরোপ-আমেরিকা যাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইনবাউন্ড ট্যুরিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রেজাউল ইসলাম বলেন, এমনিতেই সারা বছর বিশ থেকে থেকে পঁচিশ লাখ লোক দেশের বাইরে যায়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করে ঈদের এই লম্বা ছুটিতে। এটা কি কল্পনা করা যায় বাংলাদেশে দেশী বিদেশী-সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে এতগুলো এয়ারলাইন্স থাকার এর আপনি এখন মালয়েশিয়া যাবার কোন টিকেট পাবেন না। গত দশদিন আগে থেকেই সব টিকেট শেষ। আগামী সাতদিনও থাকবে এই অবস্থা। এটা কিসের ইঙ্গিত? এর মধ্যে দেশের কিছু কিছু এয়ারলাইন্স বিদেশী কিছু হোটেলের সঙ্গে যৌথভাবে এ সময় প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা করে। মালয়েশিয়ার চেয়েও বেশি মানুষ যায় ভারতে। গত বছর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশ এখন প্রথম স্থানে আছে। প্রতিদিন সাড়ে ছয় হাজার মানুষ ভারতের ভিসা পায়। সূত্র মতে বছরে ১৫ লাখ লোক ভারত যায়। গত ৫ মাসেই বাংলাদেশ থেকে ৯ লাখ লোক ভারতে গেছে। এই ঈদে সেটা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। কারণ এখন অনেক ক্ষেত্রে কলকাতা যাওয়া কক্সবাজার থেকেও সুলভ। তাই দেশের বাইরে ভ্রমণের কথা এলে আমাদের ভারতের কথাই প্রথম আসে। আসলে শুধু অবকাশ নয়- এখন মানুষের হাতে টাকা আছে বলেই তারা দেশের বাইরে বেড়ানোর কথা ভাবতে পারেন। দেশের মধ্যেও প্রতি বছর প্রায় লাখ খানেক মানুষ ভ্রমণ করে। তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত বছর ট্যুরিজম ইয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু যেসবে যে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার ছিল আমরা তা করতে পারিনি। আমাদের বিজ্ঞাপন চিত্রগুলো ইমিগ্রান্ট বাংলাদেশীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। তবে ঈদেও এক ধরনের ট্যুরিজম হচ্ছে। ঘর থেকে দুপা ফেলে যেমন বাইরে যাচ্ছে-তেমনি আবার প্রবাস জীবন কাটিয়ে ফিরছেন অনেকেই। উভয়মুখী যাতাযাতের এই প্রবণতা দিন দিনই বাড়ছে। এতে কিন্তু পর্যটন খাত কিছুটা হলেও চাঙ্গা হচেছ। ঈদ করতে একদিকে যেমন লাখ তিনেক লোক দেশ ছাড়বেন, তেমনি লাখ দুয়েক প্রবাস জীবন কাটিয়ে ঘরে প্রিয়জনদের কাছে ফিরবেন।
×