ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই চালের বাজারে অস্থিরতা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৩ জুন ২০১৭

সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই চালের বাজারে অস্থিরতা

এমদাদুল হক তুহিন ॥ বোরোর উৎপাদন নিয়ে যতটা শঙ্কা আর সংশয় দেখা দিয়েছিল প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন ততটা কম হয়নি। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমটিতে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় মাত্র ১১ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন কম হয়েছে। আর সারাদেশে বোরোর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭৮ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও বিভিন্ন অঞ্চলে নেক ব্লাস্টের প্রভাবে মৌসুমটিতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন কম হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বোরোর উৎপাদন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বললেও মাঠ পর্যায়ে ফসলের উৎপাদন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ ও কৃষি অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, ডিএই বোরো উৎপাদনের যে তথ্য দিয়েছে প্রকৃত উৎপাদন এর কাছাকাছিই। তারা বলছেন, মাত্র ১১ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন কম হওয়ার কারণে চালের বাজারে এতবেশি প্রভাব পড়তে পারে না। তবে বন্যা চলাকালীন মূহূর্তেই চাল আমদানির ঘোষণা, সরকারী গুদামে সর্বনিম্ন মজুদ ও বেসরকারী পর্যায়ে চাল আমদানিতে শুল্কের সমন্বিত প্রভাবেই বাজারে চালের দাম বাড়ে। এছাড়াও উৎপাদন সংক্রান্ত ভুল তথ্য ও চালের সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে চালের দাম কমানোর জন্য সরকারের নেয়া একাধিক পদক্ষেপের কারণে দ্রুতই বাজারে চালের দাম কমবে বলে মনে করছেন তারা। বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে ইতোমধ্যেই আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। উঠিয়ে নেয়া হয়েছে ৩ শতাংশ রেগুলার ডিউটিও। এছাড়াও চাল আমদানিতে বিনা মার্জিনে ঋণপত্র খোলার সুযোগ পাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য প্রবাহ ও সরকার ঘোষিত নানা পদক্ষেপের কারণে বাজারে চালের দাম দ্রুতই কমতে শুরু করবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, উৎপাদনের যে তথ্য দেয়া হয়েছে এটাকে আমি ভুল তথ্য বলব না। মোটামুটি তারা কাছাকাছি পর্যায়েই আছে। কেবল উৎপাদন কম হওয়ার কারণেই বাজারে চালের দাম বেড়েছে এটা ঠিক নয়। একই সঙ্গে মোট সরবরাহের কথা চিন্তা করতে হবে। আমদানি শুল্কের কারণে বেসরকারী পর্যায়ে চালের আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। তবে শুল্ক হ্রাসের প্রভাবে বেসরকারী পর্যায়ে চালের আমদানি বাড়বে। সরকার ঘোষিত নানা পদক্ষেপের কারণে দ্রুতই চালের দাম কমে আসতে পারে। আর সরকারী পর্যায়ে কবে চাল আমদানি হবে এর সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত থাকা উচিত বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এক প্রশ্নের জবাবে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ধানের উৎপাদন কম হওয়ার পাশাপাশি চালের সরকারী মজুদ কম। যা এই মুহূর্তে ২ লাখ মেট্রিক টনের চেয়েও নিচে। ফলে চালের বাজার যাদের নিয়ন্ত্রণে তারা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এ মুহূর্তে চাল আমদানির যৌক্তিকতা থাকা সত্ত্বেও সরকারী পর্যায়ে কত দ্রুত চাল আমদানি হবে তার কোন ইঙ্গিত নেই। সরকারীভাবে চাল আমদানির তারিখ দ্রুতই ঘোষণা দেয়া উচিত। এদিকে বোরো মৌসুমের প্রকৃত উৎপাদন জানতে একাধিক প্রশ্ন করা হলেও মন্তব্য করতে রাজি হননি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ গোলাম মারুফ। তবে অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৭৮ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন কম। পাহাড়ী ঢল ও আকস্মিক বন্যার কারণে মৌসুমটিতে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বোরোর উৎপাদন কম হয়েছে ১১ লাখ ২ হাজার মেট্রিক টন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর সারাদেশে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৭৮ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড জাতের বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে ৩১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, উফশী জাতের ১ কোটি ৪৬ লাখ ৬২ হাজার ও স্থানীয় জাতের ৫২ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। আর গড়ে হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয়েছে ৩ দশমিক ৯২ মেট্রিক টন। এক্ষেত্রে হাইব্রিড জাতের গড় ফলন ৪ মেট্রিক টনের চেয়ে বেশি, হেক্টর প্রতি উফশী ধানের ফলন হয়েছে ৩ দশমিক ৮০ মেট্রিক টন ও স্থানীয় জাতের বোরো ধানের উৎপাদন ১ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এবার বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৮২ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং বলছে, ধানের উৎপাদনই এর চেয়ে কম। আর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলে আসছেন, সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন অন্তত ২০ লাখ মেট্রিক টন কম হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংই সারা দেশের উৎপাদন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। আর তাদের তথ্যমতে, ধানের উৎপাদন কম হয়েছে মাত্র ১১ লাখ মেট্রিক টন। মাত্র ১১ লাখ মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন কম হওয়ার কারণে বাজারে চালের দামে এত বেশি প্রভাব পড়তে পারে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবেÑ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ হামিদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, অবশ্যই না। ১১ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন কম হওয়ার কারণে বাজারে এতটা প্রভাব পড়তে পারে না। তবে বাজারে এক ধরনের কারসাজি থাকে। একই সময়ে সরকারের মজুদও কম। ফলে চাল কল মালিকরা অতি মুনাফার লোভে বাজারে চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি নেতিবাচক তথ্য প্রবাহতো রয়েছেই।
×