ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন লড়াই

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৩ জুন ২০১৭

পাহাড়ে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন লড়াই

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী ॥ সবুজ আর সবুজে ঘেরা পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় মহাদুর্যোগের ঘটনার পর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। সর্বত্র ফিরে আসছে স্বস্তি। এবার শুরু হয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন লড়াই। গত ১৩ জুনের ভারি বর্ষণে প্রবল ঢল ও বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পাহাড় ধসের পর রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানজুড়ে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ইতোমধ্যেই এতে অগ্রগতি এসেছে। গত বুধবার চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ একলেনে হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য সচল হওয়ার পর এখন দ্বিতীয় লেনযুক্ত সড়ক নির্মাণের তৎপরতা শুরু হয়েছে সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগের যৌথ উদ্যোগে। অপরদিকে, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পরিস্থিতিতেও ব্যাপক উন্নতি এসেছে। তবে বান্দরবানের রুমার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কোথাও নৌপথ ও কোথাও সড়কপথে এ তিন জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। এরপরও বিশেষ করে সড়কপথে পাহাড় ধসে সৃষ্ট অস্বাভাবিক পরিস্থিতি একেবারে অবসান ঘটেনি। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রিতদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। রাঙ্গামাটিতে তিন সহস্রাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সহায়-সম্বল ও বাড়িঘর হারিয়ে। তবে রাঙ্গামাটিতে ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া পরিবারের সংখ্যা সহস্রাধিক। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারগুলোর সংখ্যা নিরূপণ করছে পৌর কর্তৃপক্ষ। যেহেতু পাহাড়ের সর্বত্র ধস ও ফাটল সৃষ্টি হয়ে আছে সেহেতু আগামী দিনগুলোতে ভারি বর্ষণ হলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে মানুষের মাঝে নানা শঙ্কা বাসা বেঁধেছে। তিন পার্বত্য জেলায় একযোগে একই সময়ে এত বড় বিপর্যয়ের পর খুব দ্রুততম সময়ে জনজীবন স্বাভাবিক অবস্থার দিকে চলে যাওয়ায় সর্বত্র স্বস্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এত বড় বিপর্যয়ের পর এত দ্রুততম সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কাজে সেনাবাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার ভূমিকা অপরিসীম। রাঙ্গামাটি সদরসহ দশ উপজেলা অর্থাৎ রাঙ্গামাটি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, কাউখালি, কাপ্তাই, লংগদু, নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি ও রাজস্থলির মধ্যে সদর উপজেলার মানিকছড়ি পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার রাস্তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যান্য উপজেলাগুলোতে পাহাড়ী ঢলে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত যেমন হয়েছে, তেমনি পাহাড়ী ঢলে সহায়-সম্পদের ক্ষতিও হয়েছে। রাজস্থলি, কাপ্তাই, মহালছড়ি বান্দরবান-খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হয়েছে। খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলার মধ্যে সদর, রামগড়, দীঘিনালা, পানছড়ি, মহালছড়ি, মাটিরাঙ্গাম গুইমারা, মানিকছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ির সড়ক ব্যবস্থা পুরোপুরি সচল হয়েছে। অপরদিকে, বান্দরবানের সাত উপজেলার মধ্যে সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচির পরিস্থিতিও স্বাভাবিক। তবে বান্দরবান-রুমা সড়কে পাহাড় বিধ্বস্ত হয়ে থাকার কারণে এটি এখনও সচল করা যায়নি। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ও সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে জোরালো তৎপরতা চলছে। মহাদুর্যোগের এ ঘটনার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায়নি এখনও। তবে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের বিবরণ দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি একযোগে পাহাড় ধসের কারণও ভিন্ন ভিন্নভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। তবে এ কথা সত্য যে, রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি এবং পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকায় এ ধসের অন্যতম কারণ। অন্য কারণগুলোর মধ্যে অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়ানো বজ্রপাতের ঘটনার পাশাপাশি জুম চাষে মাটির ধারণ শক্তি হ্রাস পাওয়ার বিষয়ও এসেছে। এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ভূতাত্ত্বি¡কভাবে সুনির্দিষ্টভাবে এখনও কোন কারণ উদ্ঘাটন করা যায়নি। বিপর্যয়ের ৯ দিন পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, দুর্যোগ পরবর্তী মানুষের মাঝে স্বস্তি। পাহাড়ে মানুষের মাঝে শুরু হয়েছে জীবন সংগ্রামের নতুন লড়াই। দুর্যোগে একেবারে ল-ভ- হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোই মূলত সর্বহারা। এদের পুনর্বাসনই সবচেযে বেশি অগ্রাধিকার হয়ে পড়েছে। যে সমস্ত বাড়িঘর ও জমির মালিক প্রকৃত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সঙ্গে ভাড়ায় থাকা লোকজনও আর্থিক ও ত্রাণ সহায়তার সুযোগ নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি যে দুই বেলা খাবার পরিবেশন করেছে তা মানবিক দিক। তবে ভাড়ায় থাকা পরিবারগুলোও পুনর্বাসনের তালিকায় নাম তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনরায় কিভাবে পুনর্বাসন করা যাবে তা নিয়ে এখনও কোন ঘোষণা আসেনি। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীরা পুনরায় সেখানে বসতি গড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ায় এরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে। আর কদিন পরই পবিত্র ঈদ। মহাদুর্যোগের কারণে পাহাড়ের তিন জেলায় ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি পাহাড়ের উপজাতীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর মধ্যে যারা সহায়-সম্পদ, বাড়িঘর ও স্বজন হারিয়েছে তারাও নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রত। মহাদুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা রাঙ্গামাটি। এ শহরের সঙ্গে চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ শুরু হওয়ায় কাপ্তাই দিয়ে নদীপথে পণ্য পরিবহন ও যান চলাচল কমে গেছে। যা চলছে তা একেবারেই সামান্য। রাঙ্গামাটির বেদভেদি মুসলিমপাড়া, রুবি আক্তার ও শাহজাহান নামে নিখোঁজ দুইজনের নাম মৃত্যুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ দুর্যোগে রাঙ্গামাটিতে মৃতের সংখ্যা ১২০ জনে উন্নীত হলো। সরকার পক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সহায়তাসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা রাঙ্গামটি জেলায় তিন হাজারেরও বেশিতে উন্নীত হয়েছে। শহরের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখনও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ রয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ শুরু হলেও অন্যান্য রাজনৈতিকদের মাঝে এ ধরনের ঘটনা দৃশ্যমান নয়। বেসরকারী সাহায্য সংস্থার সংখ্যা এ দেশে যে পরিমাণে রয়েছে সকলে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লে ক্ষতিগ্রস্তদের অভাব-অভিযোগ কমে যাবে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন এবং ইউনিফের সহায়তায় রাঙ্গামাটির নয় আশ্রয় কেন্দ্রে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও ব্র্যাকের পক্ষ থেকে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে কীটনাশক ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে মশারি বিতরণ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে নগদ ১ কোটি ৬৫ লাখ লাখ টাকা, ৬০০ মেট্রিক টন খাদ্য, ৫০০ বান্ডেল ঢেউটিন, গৃহ নির্মাণ মঞ্জুরি খাতে ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। রাঙ্গামাটির সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সাপছড়িতে সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগের যৌথ উদ্যোগে ১৬৫ ফুট দীর্ঘ রাস্তা একলেনে তৈরি করার পর দ্বিতীয় লেনের কাজ শুরু হয়েছে। এ কাজ শুরু করতে গিয়ে সড়কটির দূরত্ব ৩০০ ফুটে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া যেসব পয়েন্টে পাহাড় ধসের মাটির স্তূপ ও খানাখন্দক পরিণত হয়েছে সেগুলোও পরিপূর্ণভাবে ঠিক করার কাজও এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে ঘাগড়া বাজার পর্যন্ত বাস চলাচল করছে। ঘাগড়া বাজার থেকে সিএনজিচালিত বেবিটেক্সি, মাইক্রোবাস এবং যানবাহন চলাচলের জন্য ছোট ছোট ভ্যান শহর এলাকা পর্যন্ত চলাচল করছে। অনুরূপভাবে রাঙ্গামাটি থেকে জন চলাচল ও পণ্য পরিবহন একই পদ্ধতিতে ঘাগড়া বাজার পর্যন্ত চলছে। ঘাগড়া থেকেই বড় বাসযোগে মানুষ শহরে আসছে আবার ফিরে যাচ্ছে। দুর্যোগের পর রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে দেড় হাজারেরও বেশি যে সেনা সদস্যের উদ্ধাসহ উন্নয়ন তৎপরতায় নিয়োগ করা হয়েছিল তারা এখনও কাজ করে চলেছেন। সেনা নিয়ন্ত্রণে দুর্যোগ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নে বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগে পুনরায় প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ও সড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট সকলের ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন সংগ্রামে সরকারের পক্ষে সকল সংস্থার কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
×