ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আপাতত চট্টগ্রাম থেকে এই সড়কে হাল্কা যানবাহন চলবে;###;ভারি যান চলাচলে আরও সময় লাগবে;###;বান্দরবান-রুমা এবং খাগড়াছড়ি-লংগদু সড়ক এখনও বিচ্ছিন্ন

খুলে দেয়া হলো রাঙ্গামাটি সড়ক

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২২ জুন ২০১৭

খুলে দেয়া হলো রাঙ্গামাটি সড়ক

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী/ জীতেন বড়ুয়া/এস বাসু দাশ ॥ পাহাড়ে ভূমিধস ও ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। যেসব স্থানে পাহাড় ধস হয়েছে সে সব স্থান ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত হওয়ায় সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনরায় বসতি গড়ে তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে থাকতে হবে। এতে করে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত হয়নি সে সব স্থানে ফিরে যাচ্ছে লোকজন। এদিকে, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার ৯ দিনের মাথায় বুধবার দুপুরে হালকা যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি প্রথম গাড়ি নিয়ে সাপছড়ির সংস্কারকৃত সড়ক অতিক্রম করেন। তারপর সেতু বিভাগের সচিব, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, সেনা ও সিভিল প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা একে একে গাড়ি নিয়ে এ পথ অতিক্রম করেন। এরপরই সাধারণের হালকা যানবাহন চলাচল করতে শুরু করে। ফলে চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগের দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে। তবে ভারি যানবাহন চলাচলে আরও সময় নেবে বলে আগেই সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ে গত ১৩ জুন একযোগে মহাবিপর্যয়ের ঘটনার পর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে ধীরে ধীরে। সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয় সড়ক যোগাযোগ পুনস্থাপন কাজে। বান্দরবান-রুমা সড়ক, খাগড়াছড়ি-লংগদু সড়কের যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্রতিদিনই হালকা বা মাঝারি আকারের বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সব ধরনের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে, এ দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে যা দৃশ্যমান তা হচ্ছে পুনর্বাসন। বিশেষ করে রাঙ্গামাটিতে এ সমস্যা প্রকট। কেননা, এ মহাদুর্যোগে যানবাহন ও সহায় সম্বলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এ জেলাজুড়ে। এরপর খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন জেলাতেই আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা এসব আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সেনা, পুলিশ, বিজিবি ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের খাদ্যসামগ্রী প্রদানসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান দেয়া হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ পুনরায় ক্ষতির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষিত হওয়ায় ওইসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্তরা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে নিজেদের বসতি গড়ে তুলতে পারবে তা অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। রাঙ্গামাটির আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রিতের সংখ্যা প্রায় তিন সহস্রাধিক। অনুরূপভাবে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতেও ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ী-বাঙালীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলা রয়েছে। পাহাড়ের এ তিন জেলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদের অধিকাংশই গরিব ও অসহায়। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ী এবং বাঙালী স্যাটেলারদের মধ্যে সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। রাঙ্গামাটি পরিস্থিতি প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগের ৯ দিনের মাথায় বুধবার দুপুর আড়াইটার সময় রাঙ্গামাটি শহর এলাকার সাপছড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরিকৃত বিকল্প সড়ক দিয়ে হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। এই সড়ক খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটি সঙ্গে দেশের অন্য স্থানের সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ও সড়ক বিভাগের অবিরাম প্রচেষ্টার পর এ সড়ক যোগাযোগ পুনরায় সচল হয়েছে। তবে ভারি যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। দুপুরে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বিকেলে তার নিজ গাড়িযোগে নতুনভাবে তৈরিকৃত দেড় শ’ ফুট রাস্তা সর্বপ্রথম অতিক্রম করেন। তার পর ওই সময়ে সড়ক ও সেতু বিভাগের সচিব এমএন ছিদ্দিক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার রুহুল আমিন, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের কমা-ার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজভী মজিদ ও রাঙ্গামাটির রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার গোলাম ফারুক ওই সড়ক অতিক্রম করেন। ১৩ জুনের মহাদুর্যোগের পর অতি দ্রুততম সময়ে ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে সড়ক যোগাযোগ পুনরায় সচল হওয়ায় বড় ধরনের সফলতা এসেছে। এ সময় জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সেনাবাহিনী ও সেতু বিভাগের সদস্যরা জীবনঝুঁকি নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে সড়কটি চলাচলের উপযোগী করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সড়কটি চালু করা হবে। আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছি। এটি একটি অসাধ্য সাধনের ঘটনা। তবে তিনি এও আশঙ্কা করেন, ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকলে এ সড়কটিও পুনরায় ধসে যেতে পারে। এ কারণে এ সড়ক দিয়ে ভারি যানবাহন চলাচল আপাতত বন্ধ থাকবে। সাময়িকভাবে এই সড়ক হালকা যান চলাচল উপযোগী করা হয়েছে। সড়ক বিভাগ ও সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোর যৌথভাবে টেকসই ডিজাইন করে এই সড়কটির কাজ পুনরায় স্থায়ীভাবে করবে। বুধবার সাপছড়ি এলাকায় ধসে পড়া প্রায় দেড় শ’ ফুট সড়ক সংস্কার করার পর হালকা যানবাহন শুরু হলো। অপরদিকে, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কে এখনও ঝুঁকিপূর্ণ স্পট রয়েছে ৬৫টি। পার্যায়ক্রমকে এগুলো ঝুঁকিমুক্ত হলে এ সড়ক দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। অর্থাৎ পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে। খাগড়াছড়ি পরিস্থিতি খাগড়াছড়ির সার্বিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হলেও নতুন করে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন। এ ছাড়া দুর্গত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির ও খাদ্য সঙ্কট রয়েছে। পর্যটক না আসায় জেলায় দেখা দিয়েছে অথনৈতিক সঙ্কট। এতে করে জরুরী ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিলে খাগড়াছড়িতে ভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রিতরা নিজ নিজ বাড়ি ঘরে ফিরে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়েছে। দেখা গেছে অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত। বাড়িঘরের পাশাপাশি গৃহপালিত পশুপাখি, হাঁস-মুরগি-মাছ ঢলের পানিতে ভেসে গেছে। সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে সবজি ক্ষেত। ফলে শুরু হয়েছে নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রাম। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রশাসন ও স্থানীয়দের পক্ষ থেকে যে সহায়তা দেয়া হয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন এখনও ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে পারেনি। পর্যটকশূন্য হওয়ায় এ খাতের রীতিমতো ধস নেমেছে। খাগড়াছড়ির আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সভাপতি কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া জানিয়েছেন, এলাকার হোটেলগুলো খাঁ খাঁ করছে। ফলে এ খাতে আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। পুনঃপাহাড় ধস ও ঢলের আশঙ্কায় পর্যটকদের কেউ সাজেক এলাকায় যাওয়ার সাহস করছেন না। তবে আশা করা হচ্ছে, ঈদের পরে এ পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে। বিপর্যয়ের পর যানবাহন মালিকদেরও একই বক্তব্য রয়েছে। সামনে ঈদ। ধর্মীয় এ উৎসবের আগে অন্য সময়ে যেভাবে অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব চলত বর্তমানে তা একেবারেই নেই। বান্দরবান পরিস্থিতি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ভারি বর্ষণের ঘটনায় সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস ও বিধ্বস্তের ঘটনায় বুধবার পর্যন্ত ৯ দিন রুমার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তবে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিধ্বস্ত সড়ক পুনসচল করার অবিরাম চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে পড়া ও পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ার কারণে রুমা সড়কের বাইশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোন ধরনের যান চলাচল নেই। বর্ষণের পর বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পাহাড়ী ঢলে রুমা-বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় খানাখন্দক সৃষ্টি হয়ে উভয় পাশ ধসে গেছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে প্রভাব পড়েছে জেলার পর্যটন শিল্পে। রুমার বগালেক রিজুঝর্ণা ও কেওক্রাডং-এ কোন পর্যটক নেই। রুমার বাইশ কিলোমিটার এলাকা এবং রাঙ্গামাটি সড়কে পাহাড় ধসের মাটি সরানোর কাজে প্রতিদিন অগ্রগতি হচ্ছে। সড়ক বিভাগের সঙ্গে সেনা সদস্যরা অবিরাম কাজ করে চলেছে। অপরদিকে, রুমা উপজেলার অভ্যন্তরীণ মুননু আম, খামতাং ও বগালেক রাস্তার বেহাল দশা। পাহাড় ধস ঠেকাতে সুপারিশ চূড়ান্ত হবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পাহাড়ে গত ১৩ জুন যে মহাবিপর্যয় ঘটেছে তা নিয়ে ইতোমধ্যে ২৫ দফা প্রস্তাব হয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সহসা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে। এতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। ধসের ঘটনার পর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুনরায় বসতি গড়ার ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে তাতে মানুষের মাঝে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছে তারা নতুন করে যাবে কোথায়-এমন জিজ্ঞাসা ও প্রশ্ন সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। দীর্ঘ সময়ের বসতি স্থানে আর বাড়িঘর করা যাবে না এমন সিদ্ধান্তের পর ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে নতুন উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জরুরী ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো নিশ্চিত করে তা কার্যকর করা হবে। প্রয়োজনে ওসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের নতুন স্থানে পুনর্বাসন করা হবে।
×