ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে বাজেট আলোচনা

আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি স্যাবোটাজ কিনা খতিয়ে দেখার দাবি

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২১ জুন ২০১৭

আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি স্যাবোটাজ কিনা খতিয়ে দেখার দাবি

সংসদ রিপোর্টার ॥ নির্বাচনের সামনে হঠাৎ করে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি ‘স্যাবোটাজ’ কিনা, তা নিয়ে খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে গণহারে ট্যাক্স-ভ্যাট বৃদ্ধিতে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অর্থমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি তার পদত্যাগ দাবি করে বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে অর্থমন্ত্রী ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত। লুটপাটকারীদের প্রটেকশন আর জনগণের ওপর ঢালাওভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স বসিয়ে দুর্যোগের বাজেট প্রণয়নের জন্য অর্থমন্ত্রীর উচিত পদত্যাগ করে ১৬ কোটি জনগণকে মুক্তি দেয়া। প্রথমে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, মোতাহার হোসেন, জিল্লুল হাকিম, বেগম লুৎফুন্নেছা, পংকজ দেবনাথ, শাজাহান কামাল, এ কে এম রহমতুল্লাহ, ফরিদুল হক খান, শামসুল আলম দুদু, বেগম পিনু খান, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা, সাধন চন্দ্র মজুমদার, হাবিবুর রহমান, আয়েন উদ্দিন, সাইমুন সরওয়ার কমল, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, আশেক উল্লাহ রফিক, তরিকত ফেডারেশনের এম এ আউয়াল, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ ও জিয়াউল হক মৃধা। অবশ্য শেষ সময়ে অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন প্যানেল চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য এবং গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ওপর হামলা প্রসঙ্গে বলেন, এই সংস্কৃতি কে শুরু করেছে? ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমন যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তার মন্ত্রী ব্যারিস্টার সুলতান নিউমার্কেট মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশ পাহারায় আমার পায়ের রগ কেটে দিয়েছিল। আমার পিঠে ছুড়ি মেরেছিল। আমি তখন মরে যেতে পারতাম। ২০০৪ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। বিএনপির শাসন আমলে আমাদের আওয়ামী লীগের ২২ হাজার নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। আর এই ৫ বছরে আমার এলাকায় মাত্র ২৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খালেদা জিয়া ও মওদুদের বাড়ি উচ্ছেদ প্রসঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া অন্যায়ভাবে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে ছিলেন। যখন উনাকে উচ্ছেদ করা হয়, উনি কেঁদেছিলেন। ওটা কি উনার পৈত্রিক সম্পত্তি, নাকি উনার খরিদ করা বাড়ি ছিল? একইভাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ অবৈধভাবে ৫০ বছর গুলশানের বাড়ি দখল করে ছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে তাকে সেই বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এখন খালেদা জিয়া বলছেন, সুযোগ আসলে নাকি আমাদের এক কাপড়ে বিদায় করবেন। আমরা বলছি না এক কাপড়ে। তবে আমার মনে হয় প্রসাধনী ছাড়াই আপনাকে (খালেদা জিয়া) এদেশ ছাড়তে হবে। মন্ত্রী প্রজেক্টরের মাধ্যমে তার মন্ত্রণালয়ের নেয়া বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের ভিডিওচিত্র তুলে ধরেন। এসময় সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাকে অভিনন্দন জানান। তারা (এমপি) এই ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী জানান, সকলেই কিনতে পারবেন। এ সময় মন্ত্রী ঝিলমিল প্রকল্পের ভিডিও চিত্র তুলে ধরে বলেন, বস্তিবাসীরাও আগামীতে এ্যাপার্টমেন্টে থাকবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাজধানীতে বস্তিবাসীদের জন্যও ফ্ল্যাট প্রকল্প নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘বিধ্বস্ত মন্ত্রীর বর্ণাঢ্য রূপকল্প’ আখ্যায়িত করে বলেন, জনগণের ওপর ভ্যাটের বোঝা বাড়িয়ে বাজেটের ঘাটতি পূরণ করতে চান। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে, অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। জনগণকে কল্পনার ফানুস দেখিয়ে কী লাভ? মিথ্যার বেসাতি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো থেকে লুটপাট করে বিদেশে পাচার হচ্ছে, অথচ বাজেটে সে ব্যাপারে কোন কথা উল্লেখ নেই। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন হিসেবে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, এটা কোন নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। এটা অনৈতিক কাজ। উনি নৈতিকতা ও আইনবিরোধী প্রস্তাব কীভাবে করেন? এ ধরনের প্রস্তাব উনি করতে পারেন না। অর্থমন্ত্রীর এই টাকা দেয়ার কোন অধিকার নেই দাবি করে তিনি বলেন, ট্যাক্স প্রদানকারীর টাকা দিয়ে লুটের টাকার ঘাটতি পূরণের কোন অধিকার নেই। এই জন্য তো উনাকে (অর্থমন্ত্রী) আইনের আওতায় আনতে হবে। অর্থমন্ত্রীকে এ জন্য আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। উনার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল চার্জ আনা উচিত। অর্থমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর অনেক বয়স হয়েছে। তিনি শ্রদ্ধাভাজন। এখন তার পদত্যাগ করা উচিত। অর্থমন্ত্রীকে বলব, আপনি বিদায় নিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে মুক্তি দিন। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরিফ বলেন, আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সম্পদের অপ্রতুলতা রয়েছে। তারপরও এই বাজেটের মাধ্যমে উজ্জ্বল ভবিষ্যতে পৌঁছানো সম্ভব। তিনি বলেন, এই বাজেটের জন্য কোন কোন জায়গা থেকে অর্থমন্ত্রীকে আক্রমণ করে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা তো চূড়ান্ত বাজেট নয়। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। জাতীয় পার্টির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘দেশের মানুষের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ তামাশা’ উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচন সামনে। জনগণের ওপর ১৫ ভাগ ভ্যাট দিয়ে অর্থমন্ত্রী ভোট নষ্ট করলেন। তাই আপনার কাছে মাফ চাই, আপনার কাছ থেকে জনগণ আর কোন বাজেট চায় না। ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে পারবে না, তবে কোথায় রাখবে? তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী তাদের প্রটেকশন দিয়ে যাচ্ছেন। জনগণের ওপর ট্যাক্স বসিয়ে ধ্বংস হতে বসা ব্যাংকগুলোকে মূলধন দেবেন কেন? সৎসাহস থাকলে লুটপাটকারীদের নাম বলুন, জনগণ জানুক। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা আপনাদেরই লোক। লুটেরাদের প্রটেকশন দেবেন আর গরিবদের ওপর ট্যাক্স বসাবেন- এটা কখনও মেনে নিতে পারি না। সরকার নিজেদের দুর্বলতা দেখতে পারছে না। শুধুমাত্র শেখ হাসিনার ব্যক্তি ইমেজ, দক্ষতা ও প্রজ্ঞাই সরকারের একমাত্র সম্বল। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করায় আজীবন দেশের মানুষ তাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। সারাবিশ্ব বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করলেও শুধুমাত্র অগ্নিসন্ত্রাসী-নাশকতাকারী বিএনপি-জামায়াতসহ অপশক্তিগুলো তা স্বীকার করে না। সরকার দলীয় সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ হঠাৎ করেই অর্থমন্ত্রীকে দিয়ে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি এবং তাকে তুলোধোনা করা স্যাবোটাজ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই আবগারি শুল্ক রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের বছরে আবগারি শুল্ক বাড়িয়ে কেন বিএনপি-জামায়াত জোটের হাতে ইস্যু তুলে দিলাম? এ খাতে কয় টাকা পাবেন অর্থমন্ত্রী? এটা সরকারের বিরুদ্ধে আমলাদের পরিকল্পিত স্যাবোটাজ কি না, তা খতিয়ে দেখারও দাবি জানান তিনি। সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম বলেন, খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে ক্যান্টমেন্টে আরাম-আয়েশে থেকেছেন। অথচ তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জিয়াউর রহমানের নাম বিক্রি করে উনি (খালেদা জিয়া) রাজনীতি করেন। রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। বিএনপির ওপর হামলা করতে হবে না, বরং নিজেদের অতীতের অপরাধেই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
×