ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মৌসুমি অপরাধীরা দাবড়ে বেড়াচ্ছে রাজধানী

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২০ জুন ২০১৭

মৌসুমি অপরাধীরা দাবড়ে বেড়াচ্ছে রাজধানী

শংকর কুমার দে ॥ পুলিশের ভাষায় ‘মৌসুমি অপরাধ’। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, ভুয়া ডিবি-র‌্যাব, প্রতারক চক্রসহ মৌসুমি অপরাধী চক্রের তৎপরতা। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে এ ধরনের অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। ওদের প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান পরিচালনা জোরদার করেছে। গত এক সপ্তাহে কেবলমাত্র রাজধানী ঢাকা থেকেই এ ধরনের অপরাধী চক্রের শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, চাঁদাবাজ, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও ভুয়া ডিবি-র‌্যাব সদস্য। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া পুলিশ সদর দফতরে অপরাধ বিষয়ক বৈঠকে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন। গত সপ্তাহে পুলিশ সদর দফতরে এই বৈঠকে মৌসুমি অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করার নির্দেশ দেন তিনি। ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশের পর রাজধানী ঢাকায় ঈদের মৌসুমি অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ডিএমপি সূত্রে মতে, গত বছর কেবলমাত্র অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে মারা গেছেন ৫ জন। আহত হয়েছেন ২ শতাধিক। রাজধানীর ৩ শতাধিক স্পটে ছিনতাইকারীরা ছিনিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা, যা উদ্ধার হয়নি। চাঁদাবাজি করছে সন্ত্রাসীরা। ঈদ ঘনিয়ে এলেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে এ ধরনের অপরাধীরা। চার ধরনের মৌসুমি অপরাধীদের পাকড়াও করতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ডিএমপি সূত্র জানায়, ঈদ ঘনিয়ে এলেই চাঁদাবাজি শুরু করে সন্ত্রাসীরা। এবারের ঈদ সামনে রেখে বাস টার্মিনাল ও পরিবহন সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এ ধরনের চাঁদাবাজি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই। এছাড়া অজ্ঞানপার্টি অভিনব উপায়ে নানা কৌশলে পথচারী, যাত্রীদের কিছু খাইয়ে বা মুখে রুমাল ধরে অজ্ঞান করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। এ সময়ে অজ্ঞানপার্টির হাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। ছিনতাইকারীরা রাস্তার পথচারীদের নির্জন বা সুবিধাজনক স্থানে ছিনতাই তো করছেই, এমনকি মোটরসাইকেল, বেবিট্যাক্সি, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসের মাধ্যমেও ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। ছিনতাইকারীদের কাছে ছিনতাইয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে মোবাইল ফোন। আর রিক্সারোহী মহিলা যাত্রীদের স্বর্ণালঙ্কার হচ্ছে ছিনতাইকারীদের বড় টার্গেট। ডিএমপি সূত্র মতে, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, অজ্ঞানপার্টির অপরাধীরা তৎপরতাও বেড়ে যায়। রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, বেবিট্যাক্সি স্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল, ফুটপাথ যে কোন স্থানে ওঁৎ পেতে থাকে এ অপরাধীরা। সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে অপরাধ ঘটিয়ে নিমিষেই উধাও হয়ে যায় তারা। এরা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। বেশিরভাগই চক্রই শহরের বাইরে থেকে আসে। অপরাধ করে আবার তারা শহরের বাইরে চলে যায়। তবে বস্তি এলাকার কিছু অপরাধী আছে যারা মাদকাসক্ত। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে অন্তত ২শ’ জন অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েছিল। এর মধ্যে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছর ডিবির অভিযানে অজ্ঞানপার্টির ৫৪ সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে সংঘবদ্ধ অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের তালিকা তৈরি করে গ্রেফতার অভিযান জোরদার করা হয়েছে। চাঁদাবাজির ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করে ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে। বেড়ে যায় চাঁদাবাজির ঘটনা। ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুরান ঢাকা, মিরপুর, তেজগাঁও, বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরাসহ কয়েকটি এলাকায় এমনিতেই সব সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পরিচয়ে চাঁদাবাজি চলে। বাড়ি নির্মাণ বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করলেই চাঁদা দিতে হয়। ঈদে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। আগে টপ টেরর শাহাদাৎ, কিলার আব্বাস, ইমন, জিসান, জয়, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, বিকাশ ও প্রকাশের মতো সন্ত্রাসীদের সঙ্গে উঠতি সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা আদায় করা হলেও এ বছর এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী পরিচয়েও চলছে চাঁদাবাজি। কয়েক ব্যবসায়ীকে চিরকুট পাঠিয়ে হুমকিও দেয়া হয়েছে। বড় ব্যবসায়ী থেকে ফুটপাথের দোকানদারদেরও চাঁদার টাকা গুনতে হচ্ছে। চাঁদা চেয়ে হুমকি দেয়া হচ্ছে সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবীদেরও। পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, রাজধানীতে ডিএমপির আওতাধীন আটটি ক্রাইম জোনের প্রতিটিতেই ১০-১২টি করে ছিনতাইকারী চক্র রয়েছে। সব মিলিয়ে রাজধানীতে শতাধিক চক্র রয়েছে। এই চক্রের সদস্য তিন শতাধিক। ছিনতাইকারীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে ধারালো অস্ত্র রয়েছে। মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, কখনও প্রাইভেটকারে করে তারা শহরজুড়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। রাজধানীর তিন শতাধিক স্পটে সক্রিয় সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র। ঈদ সামনে রেখে অভিনব কায়দায় ছিনতাইয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তারা। সাংবাদিক, ডিবি পুলিশসহ নানা পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে লুটে নিচ্ছে তাদের অর্থ-সম্পদ। এমনকি একশ্রেণীর নারী ছিনতাইকারীও ব্যাকমেল করে দিনদুপুরে হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। সুন্দরী তরুণীদের এই কাজে ব্যবহার করছে প্রতারক চক্র। ঈদ সামনে রেখে অভিনব কায়দায় রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই চক্রের সদস্যরা। প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এই চক্রের কবলে পড়ে ছিনতাই ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ঘটছে চাঁদাবাজির ঘটনাও। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টাকার লেনদেন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রমজান শুরুর পর পুলিশী নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে নেই ছিনতাই। দিনদুপুরে শত শত মানুষের সামনেই অস্ত্রের মুখে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। ডিএমপি সূত্র জানায়, ভুয়া ডিবি, র‌্যাব ও পুলিশ পরিচয় দিয়ে ১০ থেকে বারোটি গ্রুপ ডাকাতি ও ছিনতাইসহ অপরাধী কাজে সক্রিয় রয়েছে রাজধানীতে। এরা একই চক্রভুক্ত। র‌্যাব-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত বেশকিছু সদস্য এসব দলে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে ইতোমধ্যেই ভুয়া ডিবি ও র‌্যাব সদস্য পরিচয়দানকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কাছ থেকে ওয়্যারলেস, পুলিশের ব্যবহৃত লাঠি, হ্যান্ডকাফ এবং দুটি মাইক্রোবাস ও গাড়ি জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, রাজধানীতে এ রকম ১০ থেকে ১২ গ্রুপ সক্রিয়। পুলিশ তাদের কাছ থেকে জব্দ করেছে ‘ডিবি’ লেখা এবং ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জরুরী কাজে নিয়োজিত’ লেখা দুটি স্টিকারও। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে পুলিশ সদর দফতরে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মৌসুমি অপরাধী চক্র বিশেষ করে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে নির্দেশ দিয়েছেন। রমজান মাস শুরু হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান জোরদার করা হয়েছে, যা ঈদের পরও অব্যাহত থাকবে।
×