ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পরপর তিন নির্বাচনে ৫ ভাগ আসন ও ভোট না পেলে নিবন্ধন বাতিল

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৮ জুন ২০১৭

পরপর তিন নির্বাচনে ৫ ভাগ আসন ও ভোট না পেলে নিবন্ধন বাতিল

শাহীন রহমান ॥ পরপর তিনটি নির্বাচনে ৫ শতাংশ আসন এবং ৫ শতাংশ ভোট না পেলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশসহ নির্বাচন আইন সংস্কারের এক গুচ্ছ সুপারিশ করেছেন মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনী কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে নির্বাচনে প্রার্থিতার পক্ষে ভোটারের সমর্থনের বিষয়টি বাতিলের সুপারিশও করেছেন। সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন ফি ১ লাখ টাকা নির্ধারণের আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন নির্বাচনী আইন সংস্কারে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারদের সুপারিশ নিয়ে ইসিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ইসির সহকারী সচিব রৌশন আরা জানান, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অন্তত ছয়টি বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এখন এই সুপারিশগুলো কমিশনের বিবেচনার জন্য শীঘ্রই উপস্থাপন করা হবে। এর আগে গত মে মাসে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী আইনে সংস্কার আনতে সাতটি বিষয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত চেয়ে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। ইসির উপ-সচিব মোঃ আবুল কাসেম স্বাক্ষরিত চিঠিটি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা/জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-১৯৭২, নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা-২০০৮, সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা-২০০৮, স্বতন্ত্র প্রার্থী (প্রার্থীদের পক্ষে সমর্থন যাচাই) বিধিমালা-২০১১, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১ এবং নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ অধ্যাদেশ-১৯৭৬ (অধ্যাদেশ ১৯৭৬) এর বিষয়ে অধীনস্থদের সঙ্গে আলোচনা করে ইসিতে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ইসির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের সুপারিশমালা পাঠিয়ে দিয়েছেন। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠানো অন্য সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে ভোটের সময় সকাল ৮টার পরিবর্তে এক ঘণ্টা এগিয়ে এনে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত করা, আচরণবিধি লঙ্ঘনে অর্থদ- ১০ গুণ বাড়ানো, প্রিজাডিং কর্মকর্তার কাজ কমানো ও স্মার্ট ভোট ব্যবস্থাপনার সুপারিশও রয়েছে। এছাড়াও ভোটের নির্বাচন নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও আচরণবিধি লঙ্ঘনে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব করেছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। এছাড়াও প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাজ সহজতর করা; ইসির ব্যবস্থাপনায় ভোটার সিøপ বিতরণ, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে ইসির একই মঞ্চে বিতর্ক, ভোটকক্ষের সংখ্যা কমানো, ইভিএম ও ভোটার সচেতনতা বাড়ানো, স্বয়ংক্রিয় সিল, স্মার্ট ভোটকক্ষ তৈরিসহ একাধিক সুপারিশ রয়েছে মাঠ কর্মকর্তাদের। নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধান চালু, কোন নির্বাচনী আসনে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় ভোট করা, দুই বা ততোধিক প্রার্থী সমান ভোট পেলে বিদ্যমান লটারি প্রথা বাদ দিয়ে পুনঃ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনের বিধান বাদ, অনলাইনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা নেয়ার প্রস্তাব এসেছে মাঠপর্যায় থেকে। কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সংস্কার প্রস্তাব ছিল পাঠানোর শেষ দিন ছিল ১৩ জুন। এর আগেই মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা আইন সংস্কারের সুপারিশ ইসিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন এখন সুপারিশ নিয়ে ইসিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ইতোমধ্যে আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপের খড়সা ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। রোডম্যাপে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপসহ আইন সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। ইসির রোডম্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই নিজস্ব কর্মকর্তাদের মতামত নিল কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এর আগে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসিও ২০১৫ সালে মাঠ কর্মকর্তাদের কাছে প্রস্তাব সংগ্রহ করেছিল। সবগুলো গুছিয়ে রাখলেও তা নিয়ে তারা আর এগোয়নি। নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ ঘোষণার পর নতুন করে উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করে এটিএম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি। বর্তমানে ইসিতে ৪০টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় সব নির্বাচনেই নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দলই কেবল দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তবে যেসব দলের নিবন্ধন নেই তাদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র পরিচয়ে অংশ নিতে হবে আইন অনুযায়ী। রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রথায় প্রথমবার দলগুলোর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিবন্ধন ফি নিয়েছিল ইসি। পরে নতুন আরও দল নিবন্ধনের সময়ও ওই ৫ হাজার টাকাই নেয়া হয়েছিল। তবে আবেদন করে নিবন্ধন না পাওয়া দলকে ওই অর্থ ফেরত দেয়া হয় এখন। বিদ্যমান আইনে আচরণবিধি লঙ্ঘনে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও পর পর দুই সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে। রংপুরের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা জি এম সাহতাব উদ্দিন কমিশনে পাঠানো প্রস্তাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ নিয়ে ১৩টি, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধি ও আচরণবিধি, নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে চারটি, স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় বিদ্যমান বিধি বিলোপ, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও আটটি সুপারিশ রয়েছে। এ কর্মকর্তা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ফি অফেরতযোগ্য ১ লাখ টাকা, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অর্থদ- ১ লাখ করা, পরপর তিনটি সংসদে ৫ শতাংশ আসনে (১৫টি আসন) ও ৫ শতাংশ ভোট না পেলে নিবন্ধন বাতিলের সংস্কার আনার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে ভোটের সময় সকাল ৮টার পরিবর্তে এক ঘণ্টা এগিয়ে নেয়ারও সুপারিশ রয়েছে সাহতাব উদ্দিনের। ভোটের নির্বাচন নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও আচরণবিধি লঙ্ঘনে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব রেখেছেন এক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ১৯৭২ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ প্রণয়নের পর এ পর্যন্ত ১১ বার সংশোধনী এসেছে। এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে অন্তত ২০৯টি বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে আবারও আইন সংস্কারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে ইসির রোডম্যাপে।
×