ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একই সময়ে এত পাহাড়ে ধস ও ফাটল কেন?

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৮ জুন ২০১৭

একই সময়ে এত পাহাড়ে ধস ও ফাটল কেন?

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে একযোগে একই সময়ে এত পাহাড় ধসের ঘটনা বিস্ময়কর হয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রেখেছে বিশেষজ্ঞদের। গত মঙ্গলবার পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলাজুড়ে ভারি বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে পাহাড় ধসের ঘটনায় কেউ মর্মান্তিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা রীতিমতো গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের এমন কোন পাহাড় নেই যেখানে ফাটল ও ধস সৃষ্টি হয়নি। কেন এমন ঘটনা। পাহাড়ের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। এমনও ঘটেছে যে, বড় একটি পাহাড় অপেক্ষাকৃত ছোট একটি পাহাড়ের ওপর দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে। ধস নেমে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকায় দীর্ঘ সময়জুড়ে বসবাসরত বাসিন্দারা এ ঘটনাকে কোন দানবের আঘাত হিসাবেও অভিহিত করছে। যদিও বিষয়টি বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞায় পড়ে না। এরপরও একযোগে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা শিহরণমূলক। এখন আকাশে মেঘ দেখলেই মানুষের মনে বড় ধরনের আতঙ্কের জন্ম নিচ্ছে। প্রশাসনও হয়েছে অধিকতর সজাগ। বৃষ্টি হোক আর না হোক আবারও ধসের আশঙ্কায় দলে দলে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া জোরালো করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যে কটি কারণ এ ধসের নেপথ্যে বলা হচ্ছে তা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। দেশের এক-দশমাংশ এলাকা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সর্বত্র পাহাড় আর পাহাড় ও সবুজের সমাহার। অতীতেও ভারি বর্ষণ হয়েছে, ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। কিন্তু এমন অস্বাভাবিক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম নেয়নি। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণহানি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা সকলেরই জানা। কিন্তু গত মঙ্গলবার পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে একযোগে এবং একই সময়ে এমন ঘটনা কেন ঘটল তা নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধ্যাপক ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নগারায়ন, বসতি ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হয়েছে। এখন থেকে এ জাতীয় অপরিকল্পিত ঘটনা বন্ধ করতেই হবে। অন্যথায় আগামীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে যে তা নিশ্চিত। অপরদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন মেজর শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিদের জানিয়েছেন, মূলত চারটি কারণে এ দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে। তার মতে, পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়গুলো ৭০ থেকে ৯০ এ্যাঙ্গেলে খাড়া। এসব পাহাড়ের মাটি নরম। ফলে ভারি বর্ষণে পাহাড়ের মাটি ধস নেমেছে। দ্বিতীয়ত, ওই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণকালের সর্বোচ্চ বৃষ্টিাত রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া দশকের পর দশক পাহাড়ের গাছ গাছালি জ্বালিয়ে জুম চাষ পাহাড়ের মাটির উর্বরতা শক্তিকে নষ্ট করে দিয়েছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে নগরায়ন, বসতি স্থাপন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নতো রয়েছেই। এসবের কারণে পাহাড়ের ভীত নড়বড়ে হয়ে গেছে। তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়গুলো প্রায় লাগোয়া। কোথাও কোথাও পাহাড়ের মাঝখানে কেটে তৈরি করা হয়েছে সড়ক ব্যবস্থা।আর পাহাড়ের পাদদেশে মাটি কেটে বাড়ছে বসতি। সার্বিক কারণে এবার বড় ধরনের ধসের সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যান্য সূত্রে বলা হচ্ছে, পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট, মনুষ্য সৃষ্টি। এ পাহাড়র ওপর ক্রমান্বয়ে যে আঘাত চলে আসছে তারই বিপরীতে পাহাড় নির্মমভাবে প্রতিশোধ নিয়েছে। অতীতে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়গুলো অক্ষত ছিল। সে অবস্থায় এখন আর নেই। সত্তর দশকের পর থেকে পাহাড়ে মানুষ বাড়ছে। কোথাও কোথাও ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। তবে এখনও এমন পাহাড় রয়েছে যেখানে জনবসতি হাতেগোনা। পাহাড়ের চূড়ায়, পাদদেশে স্বল্প ও অধিক মাত্রার দূরত্বে ছোট ছোট বসতি রয়েছে। কিন্তু জুম চাষের জন্য প্রতিবছর পাহাড়ের বড় একটি অংশ জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া হয়। এরপর চলে জুম চাষ। পরের বছর সেই পাহাড়ে চাষ হয় না। পাহাড়ীরা নতুন পাহাড়ের সন্ধানে উঠেপড়ে লাগে এবং অনুরূপভাবে আগুন লাগিয়ে গাছগাছালি ও বৃক্ষরাজি পুড়িয়ে ফেলে। এ প্রক্রিয়ায় পাহাড়ের ক্ষতি ব্যাপক। গত মঙ্গলবার পাহাড়ের তিন জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানির ঘটনাও এ জেলায় সবচেয়ে বেশি। পাহাড়ের সরকারী প্রশাসনের কাছে কি পরিমাণ পাহাড় রয়েছে এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। আবার পরিসংখ্যান করাও কঠিন। কেননা, প্রতিটি পাহাড়ই লাগোয়া। মানুষের সুবিধার জন্য বিভিন্ন স্থানে যেভাবে পাহাড় কাটা হয়েছে তাতে উন্নয়ন হয়েছে বটে, কিন্তু পাহাড়ের মজবুত ভীত একেবারে নড়বড় হয়ে আছে। এরই ফলশ্রুতিতে ভারি বর্ষণে পাহাড় নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। ধসে পড়েছে অসংখ্য পয়েন্টে। ফাটল ধরেনি এমন কোন পাহাড় পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এ অবস্থায় আগামীতে ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও বর্ষণের এ দেশে এ পাহাড়ে নতুন করে অনুরূপ ঘটনা ঘটলে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। সঙ্গত কারণে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, এখন থেকে অপরিকল্পিতভাবে কোনভাবেই আর পাহাড়কে আর আঘাত করা যাবে না। গত মঙ্গলবারের ধসের যে মাত্রা তা অস্বাভাবিক। ১শ থেকে ৭শ ফুট নিচে পর্যন্ত পাহাড়ের মাটি ধসে গেছে। সাথে ল-ভ- করে দিয়েছে মানুষের জীবন ও সহায় সম্পদ। এখন প্রশ্ন উঠেছে, যেসব পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তা ভবিষ্যতে কোন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়। পাহাড়কে মেরামত করার কোন সুযোগ নেই। তবে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে রিপোর্ট ও সুপারিশ আহ্বান করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানানো হয়েছে, তারা চারটি কারণ নির্ণয় করে রিপোর্ট পেশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু এসব কারণ কারও অজানা নয়। কিন্তু অজানার ব্যাপারটি রয়ে গেছে গত মঙ্গলবার একই সময়ে একযোগে দেশের এক-দশমাংশের পাহাড়ী অঞ্চলে এমন তা-ব কেন এবং কি কারণে ঘটে গেল। রাঙ্গামাটি বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির গহীন অরণ্যের পাহাড়গুলোর পূর্ণ বিবরণ এখনও প্রশাসনের কাছে পৌঁছেনি। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণও কঠিন। নিহতের সংখ্যা নিরূপণ করা ধীরে ধীরে কমে আসছে। এলাকার অনেকের দাবি রয়েছে, মাটিচাপায় নিখোঁজের সংখ্যা একেবারে কমও নয়। এসব ঘটনা নিয়ে পাহাড়ে মানুষের মাঝে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা সময়সাপেক্ষ। এখন চলছে দ্রুতগতিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। যে কারণে শনিবার থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সাপছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি শহর পর্যন্ত প্রায় এগার কিলোমিটার রাস্তা সচল করা। এ সচল করার কাজ যে কত কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর ওপর আবার থেমে থেমে বর্ষণ চলছে। ফলে সর্বত্র সৃষ্টি হয়ে আছে পুনঃধসের শঙ্কা। এ শঙ্কা নিয়ে প্রশাসন এতই উৎকণ্ঠিত যে, পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশ থেকে মানুষকে এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়েছে, অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অবিলম্বে এ ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট গ্রহণ করে তা কার্যকর করার উদ্যোগ সরকারকে নিতেই হবে। অন্যথায় বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবা হলে তা হবে অস্বাভাবিক। ঘটতে থাকবে নতুন নতুন ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা। এ অবস্থায় পাহাড়ে যদি ভূমিকম্প হয় তাহলে পরিস্থিতি অর্থাৎ বিপর্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আগাম বলা অসম্ভব বিষয়ে পরিণত হয়ে আছে।
×