ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ড. মোঃ নাছিম আখতার

মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রতিকার অনুসন্ধান

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৮ জুন ২০১৭

মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রতিকার অনুসন্ধান

পাহাড়ের ইতিহাসে এ এক মহাবিপর্যয়। তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির জানমাল ও সহায় সম্বল ভয়াবহতম ক্ষতির শিকার। গত ১৩-০৬-২০১৭ মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হয় বিপর্যয়। সকাল ১০টা থেকে ঘণ্টাদুয়েক সময়ের মধ্যে একযোগে বড়, মাঝারি ও ছোট ধরনের পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর আগের রাতে ভারি বর্ষণের জের হিসেবে বিভিন্ন পাহাড়ে সৃষ্ট ফাটল থেকে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৫১-এ উন্নীত হয়েছে। এ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকার চিন্তা সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য। এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে দেশ। বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন ও ভারত। চীনের জনসংখ্যা যথাক্রমে ১৩৮ কোটি এবং আয়তন ৯৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার প্রায়। ভারতের জনসংখ্যা ১২১ কোটি এবং আয়তন ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ২৪০ বর্গ কিলোমিটার। চীন, ভারত এবং বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ১৪৩ জন, ৩৬৮ জন এবং ১০৮৪ জন। এই তিনটি দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাসরত জনসংখ্যার তুলনামূলক চিত্রে প্রতীয়মান হয় যে, চীনের তুলনায় আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব সাড়ে ৭ গুণ বেশি এবং ভারতের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে আমাদের জনসংখ্যা অনেক আগেই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। আর এখন তা অসনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মানুষ বসবাসের জন্য পানি সমৃদ্ধ, উর্বর সমতল জায়গা পেলে কখনোই পাহাড়ে বসবাসের উদ্যোগ নেবে না- এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ১৯৭৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা যখন ৭ কোটি ছিল তখন পার্বত্য জেলাগুলোর মোট জনসংখ্যা ছিল ৫ লাখ। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী পার্বত্য জেলাগুলোর মোট লোকসংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। নিশ্চয়ই ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই লোকসংখ্যা আরও বেড়েছে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান, রাস্তা-ঘাট, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি তৈরি করতে হয়েছে এই পাহাড়ী জনপদে। ফলে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অপরিকল্পিতভাবে কাটতে হয়েছে পাহাড়। এছাড়া ইট-ভাঁটির মাটি যোগান দিতেও এক শ্রেণীর মানুষ পাহাড় কাটায় লিপ্ত। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্যেও পাহাড় কেটে সমান করে কৃষি জমি তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- পাবর্ত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলো প্রায় বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। একসময় এই পাহাড়ে ছিল সেগুন, গর্জন, গামারী গাছের সমৃদ্ধ বাগান এবং বন্য জীব-জন্তুর অভয়ারণ্য। কিন্তু মানুষের লোভ ও প্রয়োজনের কারণে পাহাড়গুলো হয়েছে বৃক্ষশূন্য। আমাদের পাহাড়গুলো মাটির তৈরি। পাহাড়ে বড় নেই। তাই গাছের শেকড় প্রাকৃতিকভাবে মাটি ধরে রাখে, সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অতি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে। পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর ফলে হর হামেশাই ভারি যানবাহন ওই সকল রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। বড় গাড়ি চলার সময় মাটিতে যে কম্পন সৃষ্টি হয় সেই কম্পনও পাহাড়ের মাটিকে প্রতি মুহূর্তে আন্দোলিত করে আলগা করে দিচ্ছে। ফলে ভিজে গেলেই এই মাটিতে ধসের সৃষ্টি হচ্ছে। এ গেল পাহাড়ে ভূমি ধসের কথা। ঢাকা শহরে ওয়াসা ৭৪০টিরও বেশি ডিপ টিউবওয়েল দ্বারা প্রতিদিন ভূগর্ভস্থ পানি তুলছে নগরবাসীর প্রয়োজন মেটাতে। যা একসময় কঠিন মানবিক বিপর্যয় ঢেকে আনতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে মাটির গভীরে যে শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে যেকোন দিন হঠাৎ করে আংশিক বা পুরো ঢাকা শহরটি মাটির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। আমাদের বিশেষজ্ঞগণ এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করছেন এবং এই বিষয়ে লেখালেখিও করছেন। কিন্তু আমাদের বোধোদয় হচ্ছে না। ঢাকার চারপাশে যে নদীগুলো আছে সেগুলো দূষণমুক্ত করে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করছি না। বরং বিভিন্ন অবৈধ দখল, কল-কারখানা এবং স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে নদীগুলোকে আরও জীর্ন-শীর্ণ, দূষিত ও মৃতপ্রায় ব্যবহার অযোগ্য নদীতে পরিণত করছি। এই অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকা-ের জন্য ভবিষ্যতে আমাদের চরম মূল্য দিতে হতে পারে। গত ০২-০৫-২০১৭ দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ”পানির বিকল্প উৎসের সন্ধানে” শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। ওই লেখায় আমি এসি হতে নির্গত পানিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি। আমি একটি গাণিতিক হিসাবের মাধ্যমে দেখিয়েছি যে, এই পদ্ধতিতে প্রতিদিন ২০ কোটি লিটার স্বচ্ছ পানি পাওয়া সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে নিজ উদ্যোগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও ঢাকা ওয়াসার এমডির সঙ্গে দেখা করি। ঢাকা ওয়াসার এমডি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। তিনি আরও কয়েকজন পানি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেন যে, আমার প্রস্তাবটি তত্ত্বীয়ভাবে সঠিক। তাই তিনি ঢাকা ওয়াসার রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট শাখায় আমার প্রস্তাবনাটি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গতিহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশে^র উন্নত দেশে জনহিতকর ও গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জাতীয়ভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত করা হয় এবং নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কোন কালক্ষেপণ করা হয় না। আমাদের দেশের জন্য এমন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির বাস্তবায়ন গতিহীন হয়ে পড়াটা পরিতাপের বিষয়। কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তা নিয়ে বেশ হইচই ও লেখালেখি হয়। কিন্তু তার আগেই ঝুঁকি এড়াতে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বিপর্যয় ঘটার আগেই প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তাহলেই কেবল মর্মান্তিক বেদনাবিধুর বিয়োগান্তক বিপর্যয়গুলো সংঘটিত হবে না এবং সরকারকেও পড়তে হবে না কোন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। মানুষের জীবনে জন্যে গাছপালা যেমন দরকারী তেমনি অপরিহার্য অক্সিজেন ও পানি। এই পানি ও অক্সিজেন পরোক্ষভাবে আসে গাছ থেকে। একটি পূর্ণবয়স্ক মাঝারি গাছ প্রস্বেদনের মাধ্যমে দিনে ১০০ গ্যালন পানি বায়ুম-লে ছড়ায়। শিল্পায়ন ও ঘর-বাড়ি তৈরির জন্যে কিছু গাছপালা কাটা পড়ে। কিন্তু যখন দেখি সৌন্দর্য্য বর্ধনের দোহাই দিয়ে বড় বড় গাছ নির্বিচারে কেটে বালি ফেলে শ্যামল প্রকৃতিকে আরবের মরুভূমিতে পরিণত করছে, তখন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে হৃদয়। গত ১৬-০৫-২০১৭ জাতীয় দৈনিক পত্রিকার “গাছ লাগিয়ে যতœ নিলেই লেখাপড়া ফ্রি!” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরে প্রকাশ ভারতের অসম রাজ্যের সরকার প্রথম বছরে যারা বিনা পয়সায় ভর্তি হয়েছে, তাদের দ্বিতীয় বর্ষেও একই সুবিধা নিতে হলে লাগাতে হবে গাছ। শুধু লাগালেই চলবে না, সারাবছর যতœ নিয়ে সেই গাছের ছবি পেশ করতে হবে স্কুলে। তবেই মিলবে দ্বিতীয়বার বিনা পয়সায় ভর্তির সুযোগ। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এমন অভিনব পন্থায় বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সবুজ বন সৃজন করা সময়ের দাবি। যে কোন মূল্যে প্রয়োজন জীবনের স্পন্দন পানিকে সুরক্ষিত রাখা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মকা-কে বেগবান করা। প্রকৃতিকে পরিমিত শাসন সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু তা অতি শাসনে রূপ নিলেই ম্যালথাসের তত্ত্ব অনুযায়ী প্রকৃতি মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেবেই-নেবে। প্রকৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত ও রিক্ত না করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটালে, আমাদের পরিবেশ হবে বাসযোগ্য এবং আমরা থাকব নিরাপদ ও সুরক্ষিত। লেখক : বিভাগীয় প্রধান কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, গাজীপুর
×