ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

দুই নৌকায় পা দিয়ে তীরে ওঠা যায় না!

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১৮ জুন ২০১৭

দুই নৌকায় পা দিয়ে তীরে ওঠা যায় না!

মুক্তিযুদ্ধে জয় হয়েছিল একটি মাত্র লক্ষ্যে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার কারণে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই এক মুখী লক্ষ্যকে দ্বিধা বিভক্ত করতে খোন্দকার মুশতাকসহ একটি গোষ্ঠী পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করে দুই প্রদেশ মিলে পাকিস্তান রক্ষার চক্রান্ত করেছিল যেটি অভিজ্ঞ, মেধাবী প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমদ নস্যাত করে দিয়েছিলেন। নতুবা মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত জাতি দুই নৌকায় পা দিয়ে বিজয় দূরে থাক, অকূল দরিয়ায় পথ হারিয়ে পাকিস্তানের বর্বর অন্ধকারের মানবিক বোধহীন শক্তির দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী হতো! পরম সৌভাগ্য আমাদের যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কা-ারির নেতৃত্বে আমরা এক নৌকায় একত্রে যুদ্ধের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়টি সফলভাবে পাড়ি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের কূলে এসে পৌঁছেছিলাম। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখি, নবীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মদাতা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নবীন সেনাবাহিনী গঠন করেছেন। কিন্তু পরে তাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলো পাকিস্তান ফেরত সেনা সদস্যরা যাদের মধ্যে বাংলাদেশ বিরোধী এবং পাকিস্তানের প্রতি অনুগত একটি অংশ থাকাটা খুব স্বাভাবিক ছিল। সুতরাং সেনাবাহিনীতে বিভক্তি, তাও আবার মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানপ্রেমী, দুই বিপরীত মেরুর স্বার্থের দ্বন্দ্ব সূচিত হবে এমনটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিউবার বিপ্লবী নেতা ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন- নবীন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী গঠিত হতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে, এতে কখনও শত্রু দেশে বন্দী দেশীয় সেনাদের যুক্ত করা সঠিক নয়, এরা কখনও না কখনও পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ ছাড়বে না। যদিও এদের সবাই পাকিস্তান প্রেমী ছিল না, কিন্তু নিয়ম হচ্ছে, যুদ্ধ শেষে শত্রু দেশে বন্দী থাকা সেনাদের সরাসরি সব সুবিধা দিয়ে অবসরে পাঠানো। পাকিস্তান সরকার এ নিয়মে যদিও তাদের সেনারা তাদেরই নির্দেশে বাঙালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তবু তারা সব উচ্চ, নিচ সেনা সদস্যদের অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যদিও এর পরেও তাদের সেনাবাহিনী অবশ্য বার বার স্বদেশ দখল করতে ক্যু করে বহুবার। যাই হোক, এই বিভক্তি বেসামরিক প্রশাসনে দৃশ্যমান সমস্যা সৃষ্টি না করলেও ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেখা গেল কুমিল্লা ষড়যন্ত্রে মুশতাকের সঙ্গে শুধু সেনাসদস্য নয়, কিছু আমলাও সংশ্লিষ্ট ছিল। তবে, বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই বাঙালী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের প্রধান শত্রু হিসেবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং এ রাজনীতির ফসল দেশদ্রোহী পাকিপ্রেমী জামায়াতী যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করেছিলেন। এরই অনুসরণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে চির নির্বাসনে পাঠানোর লক্ষ্যে বাঙালীকে চিরদিনের জন্য শত্রুমুক্ত রাখতে সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে যোগ করেন অন্যতম মৌলনীতি হিসেবে। অন্যদিকে সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের গ্রেফতার করে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেছিলেন। ধার্মিক বঙ্গবন্ধু ধর্মকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহারকারীদের অভ্রান্তভাবে চিহ্নিত করে বাঙালীর শুধু নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রুদল, ভবিষ্যতেও ধর্মকে বার বার বাঙালীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সম্ভাবনা চিরতরে দূর করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে কোন ভুল করেননি। অসাম্প্রদায়িকতা যে বাঙালীর প্রাণবীজ, তার সংস্কতির মৌলিক উপাদান-তা সম্ভবত আর কোন রাজনীতিক বঙ্গবন্ধুর মতো এত স্বচ্ছভাবে বুঝতে পারেনি। যেখানে জওহরলাল নেহরু প্রমুখ ভারত সেরা রাজনীতিকরাও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে স্থান দিয়ে সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবেননি, সেখানে বঙ্গবন্ধু ‘৭২-এ, পাকিস্তানী জেলখানা থেকে ফেরত এসে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র অর্থাৎ বৈষম্যহীন সমাজ এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন। এমন কি এগার মাস ফাঁসির দ- মাথায় নিয়েও এই সত্যকে ভুলে যাননি। বঙ্গবন্ধু যে বাঙালীকে তার অস্তিত্বের প্রধান শত্রু-সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মব্যবসাভিত্তিক রাজনীতি থেকে চিরতরে রক্ষা করতে ৭২-এর সংবিধানে যে রক্ষাকবচ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তার হত্যার পর বাঙালীর শত্রু, বাংলাদেশের শত্রু এবং পাকিস্তানের মিত্ররা জোট বেঁধে সে সুরক্ষা শর্তগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। প্রকৃত পক্ষে বলা চলে, ২০০৮-এর নির্বাচনে নতুন প্রজন্ম ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মহাজোটকে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী রাজনৈতিক দলের মহাজোট সরকারের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করা সম্ভব হয়। তরুণ প্রজন্ম সরকারকে এ কাজে গণজাগরণ মঞ্চ গঠন করে পাশে অবস্থান করে সমর্থন দিতে থাকে। এ সময়েই সমাজে ’৭১-এর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হারানো মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ফিরে পায়। বীরাঙ্গনারা সম্মান ও মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পায়। দেশ গড়ার কৃষক, শ্রমিক সরকারের যথাযথ সহায়তা পেয়ে দেশকে খাদ্যে, পণ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে। বলা বাহুল্য, এই ২০০৮ থেকে জাতি দেখতে পেল সরকার মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই প্রথম কোন সরকার ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের নেতাদের জাতির জন্ম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করে বিচার করেছে এবং ফাঁসির দ-ও দিয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মহাজোট সরকার আর কখনও জাতির শত্রু- সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ধর্মীয় কোন দলের সঙ্গে সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের নীতিবিরোধী মিত্রতা করবে না। ধর্মীয় যে কোন দল থেকে তফাতে থাকবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ও মহাজোট- এটিই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জাতির আশা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে প্রধানমন্ত্রী, মহাজোট নেত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ার স্বপ্ন রচনাকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা হেফাজতে ইসলাম নামের এক কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক মৌলবাদী দল যারা খালেদার নির্দেশে সরকার উৎখাতের আন্দোলনের নামে ঢাকায় চরম তা-ব চালাল, তাদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা করে! কে না জানে, হেফাজতকে ঐদিন সভার সময় বেঁধে দেওয়ার পর ওই স্থানে এবং মতিঝিলে ১৪৪ ধারা জারি করে তাদের স্থান ত্যাগ করতে সহজে বাধ্য করা যেত। রাতভর তা-ব, ভাংচুরের হুকুমদাতা হিসেবে আহমদ শফী থেকে শুরু করে সব হেফাজত নেতা ও জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতি ক্যাডারদের গ্রেফতার ও মামলা শুরু করাই হতো যথার্থ পদক্ষেপ। যে গণজাগরণ মঞ্চকে কেন্দ্র করে সারাদেশে লাখ লাখ তরুণ, প্রবীণ, কিশোর, শিশু দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জ্বল করেছে, আকস্মিকভাবে সরকার তাদের পুলিশ দিয়ে শাহবাগ থেকে সরিয়ে দিল! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারীরা হঠাৎ সরকারের রোষানলে পড়ল! যা ছিল সমস্ত দেশ ও বিশ্বের দেশে দেশে অবস্থানকারী বাঙালীদের কাছে বজ্রপাতসম! অনেক প্রবাসীর কাছে এ প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমরা জর্জরিত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণজাগরণ মঞ্চকে ভেঙ্গে দিল কেন সরকার? ওদের কি দোষ ছিল? দরকার হলে ওদের জাদুঘরের সামনে বা টিএসসির মোড়ে জায়গা দিতে পারত, হেফাজতের দাবির মুখে কি ওদের সরানো হলো? এসব প্রশ্নের, হতাশার, ক্ষোভের কোন উত্তর ছিল না আমার কাছে। আমি নিশ্চিত, এসব প্রশ্নের উত্তর প্রধানমন্ত্রীও দিতে পারবেন না। এদিন থেকেই কি তিনি দুই নৌকায় পা দিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, গণজাগরণ, মুক্তিযোদ্ধা, অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষগুলোর ভোট তো আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের জন্য আছেই, এবারে মৌলবাদী দলগুলোর থেকেও কিছু ভোট যা খালেদার ভোট বাক্সে যায়, সেখান থেকে নিয়ে আসা যায়? বলতেই হবে, এটি কখনও হওয়ার নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’মতের দু’গোষ্ঠীর মানুষকে কিছুতেই কোন কারণেই এক জোটে আনা যায় না। তাছাড়া এ ভাবনাটাই অরুচিকরও বৈকি! ভোটের রাজনীতিতেও ন্যূনতম, মুক্তিযুদ্ধ যদি ঐক্যের জায়গা হতো, তাহলেও সম্ভব হতো, কিন্তু হেফাজত ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল বলে তথ্য আছে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে একমাত্র জামায়াত ও জামায়াত-মিত্র খালেদার সঙ্গে। সত্যি বলতে কি, এরা মৌলবাদী তিন গোষ্ঠী স্বাভাবিক মিত্র, এরা উপরি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দল থেকে জমি, অর্থ পেলে না নেওয়ার কোন কারণ নেই, তাই বলে ভোট দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পন্থী দল বা মহাজোটকে জয়ী করবে কেন? তাদের ‘প্রিয় পাকিস্তান’ ভাঙ্গার দলকে তারা ক্ষমা করবে, এমন ভাবার কোন কারণ ও সুযোগ নেই। তাছাড়াও, স্মরণ রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ যখন যেবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, তখন কোন মৌলবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সহায়তায় জিতেনি, জিতেছে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বৃহত্তর প্রগতিশীল এবং ধর্মভীরু কিন্তু অসাম্প্রদায়িক কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী ও তরুণ প্রজন্মের ভোটে এবং হিন্দু, সংখ্যালঘুর ভোটে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়- বঙ্গবন্ধুর দেয়া ছয় দফা এতই যুক্তিযুক্ত ছিল যে গ্রামগঞ্জের কৃষক, শ্রমিক, শহরের শিক্ষিত প্রগতিশীল সব পেশাজীবী এবং ছাত্র, নারীরা, সংখ্যালঘুরা বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে জয়ী করেছে, মোল্লা, মৌলানারা নয়। এরপর তারই আহ্বানে- এই অসাম্প্রদায়িক সব ধর্মের নারী, পুরুষ স্বদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখানে তার পাশে, আওয়ামী লীগের পাশে কোন ধর্মজীবী গোষ্ঠীর সমর্থন সহযোগিতা ছিল না, এর প্রয়োজনও ছিল না। এখন তো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, ধর্মভিত্তিক দল ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের অধিকাংশ বড় নেতার বিচার সম্পন্ন হয়েছে এবং স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলছে। এর আগে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার ও দ- প্রদান কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চকে কেন্দ্র করে নতুন প্রজন্মের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী ’৭১-এর মতোই সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে মৌলবাদীদের দ্বারা ধর্মের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও মগজ ধোলাইয়ের ফলে দেশকে অস্থিতিশীল করতে, দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে যে জঙ্গী মৌলবাদী উগ্র খুনী দলের উত্থান ঘটানো হয়েছে, তাদের বড় একটি অংশকে সম্প্রতি দেশপ্রেমিক পুলিশ র‌্যাব নিশ্চিহ্ন করেছে। জঙ্গী নির্মূলে আরও অভিযান চালানো হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে সরকারের কারও কাছে নতজানু হওয়ার দরকার নেই, বরং দৃঢ় অবস্থান ও ভূমিকাই মৌলবাদীদের নতজানু করবে। সর্বোপরি সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুকে সাম্প্রদায়িক করার অন্যায় প্রস্তাবকে প্রধানমন্ত্রীর মেনে নেয়া মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা যা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের উল্লসিত এবং হেফাজতকে সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রমাণ করেছে। এরা কি মহাজোট সরকারের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে? তাই যদি হতো, তাহলে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমকেই তারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করে আধুনিক করতে মুহূর্ত দেরি করত না। তারা কি তা করার জন্য বিন্দু মাত্র আগ্রহ কখনও প্রকাশ করেছে? তারা কি স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধকে, এর চেতনাকে স্বীকার করে? তা না করে একজন মুক্তিযোদ্ধার মতোই সব নাগরিক অধিকার ভোগ করবে? যারা কওমী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে তারা কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাধারণ শিক্ষার সরকারী, বেসরকারী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার যোগ্য হয়? তারা কি সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার যোগ্য? এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কি দেশপ্রেমিক হয়ে গড়ে ওঠে? যারা বিপুল সংখ্যক দেশপ্রেমহীন শিক্ষার্থী তৈরি করে, তাদের সঙ্গে কি কোন আপোস হতে পারে? তাতে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের, আমাদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুণœœ হয় না? বর্তমান মহাজোট সরকারকে কোনভাবেই ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভুল করার সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী বিপুল জনগোষ্ঠী কখনও দেয়নি এবং কখনও দেবে না। নির্ভরযোগ্য, পরীক্ষিত এবং আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের কারিগররাই হচ্ছে মহাজোট এবং আওয়ামী লীগের ভোটার, সমর্থক এবং যোদ্ধা। এদের যারা ‘মুরতাদ’ বলে, তারা কিভাবে আওয়ামী লীগের কৌশল গত মিত্র হয়? একদিকে অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ নির্মাণে ব্রতী জনগণ, অন্য দিকে এ সাম্প্রদায়িক, বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল- এই দুই নৌকায় পা রাখা যে কোন ব্যক্তি বা দলের পক্ষে অসম্ভব। এর পরিণতিও হবে নেতিবাচক। আমরা, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাচীন শৃঙ্খলে বন্দী শিশু, কিশোর, তরুণদের মুক্তি চাই। তারা স্বাভাবিক বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষা লাভ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যাতে অংশ নিতে পারে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গর্বিত নাগরিক হতে পারে- এটিই চাই। দুই নৌকায় পা দিয়ে এ কাজ করা সম্ভব নয়। নৌকা একটিই যেটি বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, সাধারণ শিক্ষার সাম্প্রদায়িক পরিবর্তনগুলো পূর্ববর্তী অবস্থানে আনার জন্য শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের কাজ এতদিনে শুরু হয়েছে। কেননা ২০১৮ তে নতুন বইগুলোকে হতে হবে অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী পাঠ্যপুস্তক। নতুবা মহাজোটের অনেক অর্জন স্লান হয়ে যাবে যা ভোটের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। আবারও স্মরণ করাতে চাই- আওয়ামী লীগ কখনও কোন মোল্লা দলের ভোটে জেতেনি। মোল্লারা কখনোই ওদের ভোটার নয়, ছিল না, হবে না। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সব মাদ্রাসাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করার শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যার অন্য কোন বিকল্প নেই। ‘৭১-এর সহজ কাজটা এখন কঠিন হলেও মোটেও অসম্ভব নয়। আল-আজহার, আলীগর, প:বঙ্গের মাদ্রাসাগুলো এ কাজের উদাহরণ হতে পারে। চিন্তা করুন, উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ হেফাজতের নির্দেশে হওয়া সম্ভব? নাকি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম দ্বারা সেটি সম্ভব হবে? লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক
×