ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী রমণীর শিল্প মনের বিকাশে পিঠা

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৭ জুন ২০১৭

বাঙালী রমণীর শিল্প মনের বিকাশে পিঠা

বৈচিত্র্যময় গ্রামবাংলার মানুষের সৌন্দর্য চেতনার কত যে বিচিত্র রূপ নানা জায়গায় নানা কাজে তাদের হাতের স্পর্শে ছড়িয়ে আছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। তেমনি একটি শিল্পমাধ্যম হচ্ছে পিঠা। পিঠা তৈরি করে মূলত রমণীকুল। বহু উপকরণ, বহুরূপে, বহু কারুকার্যম-িত এই পিঠার মধ্যে বাঙালী রমণীর রুচি, আদর, ভালবাসা, ¯েœহ-প্রীতি বিজড়িত। ভাত বাঙালীর যেমন প্রধান খাদ্য তেমনি সেই একই চালের গুঁড়ার তৈরি পিঠাও বাঙালীর প্রাচীন এবং প্রিয় খাদ্য। পিঠার পরিচয় ও আপ্যায়নের পরিচর্যা হতে প্রমাণিত যে, এক সময়ে বাংলার পিঠার কদর কত গভীর ছিল। পিঠার গঠন, আকৃতি এবং উৎকৃষ্ট মানের অলংকরণ দেখলে এর শৈল্পিক গুণাবলী বিচার করলে অবশ্যই তা লোকশিল্পের মাধ্যম হিসাবেই ধরতে হবে। এখনও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল উৎসব, পার্বণে, ঈদে, পূজায়, পীর-ফকির, দরবেশ-আউলিয়ার মাজারের শিরনিতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনকি বিশেষ ধরনের যে কোন অনুষ্ঠানে পিঠা তৈরি ও আপ্যায়নের রেওয়াজ প্রচলিত। যদিও কালের পরিবর্তনে সে প্রাচুর্য আর নেই, যা আছে তা আমাদের ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি ও তার স্মৃতিচারণ। জানা যায়, পিঠা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় তৈরি করলেও মূলত চালের গুঁড়ার পিঠায় মুসলিম সম্প্রদায়ের একচেটিয়া প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। লোক সংগ্রাহক খগেশ কিরণ তালুকদারের মতে, চালের গুঁড়ার পিঠা হিন্দু সমাজে আঁইটা বা উচ্ছিষ্ট বলে বিবেচিত হওয়ায় এগুলো তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটায়। তাই হিন্দু রমণীদের স্বাভাবিক কলা নৈপুণ্য বিকশিত হয়েছে নারকেল ও দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন তৈরিতে। অপরদিকে চালের গুঁড়ার তৈরি পিঠায় মুসলিম রমণীগণের একচেটিয়া প্রাধান্য। তাই হিন্দু রমণীদের পিঠার কারুকাজ শুধু দুগ্ধজাত সন্দেশ নাড়ু বা মিষ্টান্নতেই সীমাবদ্ধ। পিঠার কারুকার্যের ব্যাপারে মুসলিম রমণীরা তার শিল্প নৈপুণ্যের জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত। পিঠার মধ্যে নকশি পিঠাই সবচেয়ে কারুকার্যময় ও অলংকারযুক্ত। নকশি পিঠা বাংলাদেশের সব জেলায় তৈরি হয় না। এ পিঠা বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কিছু অঞ্চলে তৈরি হয়ে থাকে। এ পিঠাতে ব্যবহৃত নকশার মটিফের মধ্যে লতা-পাতা-ফুল, ঘরে ব্যবহারিক তৈজসপত্রের নমুনা, মাছ, পাখি এবং জ্যামিতিক নকশার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। নকশা তৈরির উপকরণও অতি সাধারণ। সুঁই, খেজুর কাঁটা, মন কাঁটা, বাঁশের ছিলকা ও বাঁশের চিকন কঞ্চি দিয়েই আমাদের রমণীকুল তৈরি করে অসাধারণ পাক্কন (পাকোয়ান) বা নকশি পিঠা। মটিফের সঙ্গে সাজুজ্য রেখে এর নামকরণও অদ্ভুত সুন্দর যেমন: কাজললতা, শঙ্খলতা, হিজললতা, সজনে পাতা, ভেট ফুল, উড়িফুল (সিমের ফুল), কন্যা মুখ, জামাই মুচরা, সতীন মুচরা, সাগর দীঘি ইত্যাদি। এগুলো তৈরিতে গ্রামীণ ললনাকুল যে দক্ষতার পরিচয় দেয়, তা শুধু অভিজ্ঞ শিল্পীর সঙ্গে তুলনা করা চলে। দেশে তো বটেই বিদেশেও এ পিঠা বহুবার প্রদর্শিত ও সমাদৃত হয়েছে। -মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ থেকে
×