ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে লোকজ পিঠা

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৭ জুন ২০১৭

ঈদে লোকজ পিঠা

ঈদ উৎসবে লোকজ খাদ্য মৌসুমী পিঠা বাঙালীর প্রাচীন ঐতিহ্য। গ্রামগঞ্জ থেকে এ ঐতিহ্য এখনও হারিয়ে যায়নি। গ্রামের বৃদ্ধ দাদি-নানি, মা-চাচি ও শৌখিন বৌ-ঝিরা এ প্রথাকে আজও টিকিয়ে রেখেছে। পিঠা শুধু লোকজ খাদ্য নয়, এটা বাংলা ও বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। পারিবারিক ও সমাজ জীবন থেকে পিঠা তৈরির প্রচলন কমে গেলেও বিভিন্ন উৎসবে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় বাড়ির বৌ-ঝিদের। বাঙালীদের জনপ্রিয় ও মুখরোচক খাবারের তালিকায় পিঠা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাই ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহাসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব-পার্বণে বাংলার এ লোকজ খাদ্য পিঠা মৌসুমী খাদ্য হিসেবে দেখা যায়। এ ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালী সংস্কৃতি। ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে এ অঞ্চলের সব বাড়িতেই যে পিঠা তৈরি হয়, এমনটা নয়। তবে সেমাই, ফিরনি-পায়েশ, কোরমা-পোলাও প্রায় বাড়িতেই তৈরি হয়। কোন কোন বাড়িতে কোরমা-পোলাও, সেমাই, ফিরনি-পায়েশের পাশাপাশি নানা ধরনের বাহারী পিঠা তৈরি করতে দেখা যায়। অতিথি আপ্যায়নে বাড়তি আয়োজন হিসেবে দেখা গেলেও গ্রামীণ জনপদে এ প্রচলনটা এখনও রয়ে গেছে। তবে এ প্রথা প্রত্যেক বাড়িতে নয়, কোন কোন বাড়িতে দেখা যায়। ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও উৎসব আদর আপ্যায়ন সকলে সমানভাবে উপভোগ করে। এখনও ঈদ উপলক্ষে এ জেলার চরাঞ্চলের অবস্থাসম্পন্ন গেরস্থ বাড়িতে শৌখিন বৌ-ঝিরা ছিট, ভাপা, চিতই, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, জামাই খোশ পিঠা তৈরি করে। তৃপ্তি সহকারে গরম পিঠার স্বাদ নিয়ে আনন্দ উপভোগ করে অতিথি আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব। ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহাসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব-পার্বণে যে পিঠা তৈরি হয় তা শুধু আপ্যায়ন ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতিবেশীরাও একে অপরের বাড়িতে ঈদের মিষ্টি, সেমাই, পিঠা আদান-প্রদান করে। এখনও কোন উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়া শীত মৌসুমে গ্রাম-বাংলার বউ-ঝিরা পিঠাপুলি তৈরির তাগিদ অনুভব করে। গরিব-ধনী নির্বিশেষে সকল পরিবারের বউ-ঝি পিঠে-পুলি তৈরির প্রতি মনোনিবেশ করে। পরিবারের ছেলেমেয়েদের পিঠা খাওয়াতে তারা ব্যাকুল হয়ে পড়ে। ভাত বাঙালীর প্রধান খাদ্য। কিন্তু খাদ্য রসিক বাঙালী সুদীর্ঘকাল থেকে ভাতের পরিপূরক, মুখরোচক আরও অনেক খাবার তৈরি করে আসছে। চিড়া, মুড়ি, নাড়ু, খৈ এবং রকমারি পিঠাপুলি এর মধ্যে অন্যতম। পিঠা এসব মুখরোচক খাদ্য তালিকায় সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে। কারণ লোকজ এ খাদ্য আবহমান বাংলার সামাজিকতার অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু বর্তমান সময়ে সামাজিকতার ক্ষেত্রে পিঠার প্রচলন কমে এসেছে। পিঠা শুধু খাবার হিসেবে নয় বরং লোকজ ঐতিহ্য এবং নারী সমাজের শিল্প নৈপুণ্যের স্মারকরূপেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় শহুরে নারীরা এখন পিঠা-পুলি তৈরি থেকে বিরত রয়েছে পারিপার্শ্বিক কারণে। তাদের ধারণা পিঠা গাঁইয়্যা খাবার, তাই গাঁইয়্যা নারীরাই এটা তৈরি করে। আমরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করে কেন নোংরা আটা-ময়দা-গুড় হাতে জড়াব। শহরের ৮০ ভাগ মেয়ে এ ভ্রান্ত ধারণায় বিভোর। এটা তাদের দোষ নয়, এটা অতীত শিক্ষার অপরিপক্কতা। যে কারণে বাংলার ঐতিহ্য পিঠা-পুলি এখন রাস্তা-ঘাট ও দোকানপাট থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। তবে আধুনিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রচলিত হয়েছে নতুন নতুন বাড়তি খাবার। বাজারে প্যাকেটজাত রকমারি মুখরোচক খাবার সহজলভ্য হওয়ায় পিঠার চাহিদা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অতীতে এ দেশের নারীসমাজ শিক্ষা-দীক্ষায় তেমন অগ্রসর ছিল না। কিন্তু অতীতে দেশের নারীসমাজ লোকজ শিল্পকর্মে অত্যন্ত নিপুণ ছিল। তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা পেশাগত প্রশিক্ষণ ছিল না। তবুও তাদের দক্ষ হাতের শৈল্পিক কারুকাজ মনোমুগ্ধকর। নকশিকাঁথা, মসলিন, বাঁশবেত শিল্প, মৃৎশিল্পসহ নানারকম কুটির শিল্পের প্রধান কারিগর ছিল নারী। আবহমান বাংলার নারীসমাজের সেই যোগ্যতা আজও রকমারি পিঠা তৈরিতে টিকে আছে। এখনও গ্রাম-গঞ্জের বৌ-ঝিরা সারাবছর পিঠা তৈরি করে। তবে কিছু পিঠা মৌসুমি। শীতকাল মূলত বাংলায় পিঠার মৌসুম। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। নবান্নের আনন্দে তৈরি হয় হরেক রকম পিঠা। খেজুর গাছের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে গুড় তৈরি করা হয়। দুধ ও খেজুর রসের সমন্বয়ে বানানো হয় রকমারী পিঠা। নিজে খেয়ে এবং অপরকে খাইয়ে বাংলার বৌ-ঝিরা তৃপ্তি অনুভব করে। ভোরে কনকনে শীতে কাঠের আগুনের চুলা ঘিরে বসে ভাই-বোন। আগুনে সেঁকে অথবা ছাঁচ থেকে নামিয়ে গরম গরম পিঠা বাটিতে তুলে দেওয়া হয় তাদের হাতে। আবার বিকেলে চিতই পিঠা তৈরি করে খেজুর রসে দুধ জ্বালিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয় পরদিন সকালের জন্য। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে পিঠার কদর ও প্রচলন আছে। পূজা পার্বণ, উৎসব অনুষ্ঠানে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। এখনও পৌষ সংক্রান্তিতে হিন্দুদের বাড়ি-বাড়ি পিঠা তৈরির উৎসব শুরু হয়। ঈদ-উল-ফিতরের সময় মুসলমানদের খাবার তালিকায় ঘরে তৈরি পিঠা এখনও আছে। ঈদে অতিথি ও বন্ধুবান্ধব আপ্যায়নে সেমাই, ফিরনি, পায়েশ, জর্দার পাশাপাশি নানারকম পিঠা তৈরি করা হয়। এ সময় ডুবো তেলে ভাজা চালের গুঁড়ির পিঠা ও নোনতা মসলা পিঠার এবং কোরবানি ঈদে রুটি পিঠা ও ছিট পিঠার প্রাধান্য থাকে। দেশে অসংখ্য প্রকারের পিঠে তৈরি হয়। এগুলোর নাম ও প্রস্তুতপ্রণালী বিচিত্র বর্ণিল। পিঠের গায়ে খেজুরকাঁটা বা অনুরূপ কাঠের খুঁজনি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নকশিও করা হয়, কারুকাজ করা হয়। কোন কোন পিঠার জন্য ছাঁচ আছে। কোন পিঠাতে থাকে নকশা। পিঠার জন্য আছে বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র। মাটির হাঁড়ি, নিচ দিকে ছিদ্র আছে। ভাপা পিঠা বানাতে এটি ব্যবহৃত হয়। বাংলার পিঠেপুলির বিচিত্র স্বাদ, আকার ও প্রস্তুত প্রণালী ব্যাপক। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×